গণমাধ্যমই কি শেষ আশ্রয়?


গণমাধ্যমই কি শেষ আশ্রয়?

ঢাকাই চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় অভিনেত্রী পরীমনি বিগত চারদিন বিচারের আশায় চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিসহ নানা জায়গায় ধরনা দিয়ে কারও কোনো সহযোগিতা পাননি এমনকি ঘটনার পর তিনি বনানী থানায় অভিযোগ করতে গেলেও অভিযোগ নেওয়া হয়নি। শেষে নিজ বাসায় সংবাদ সম্মেলন ডেকে মুখোমুখি হন গণমাধ্যমের এবং সংবাদ সম্মেলনে তিনি স্পষ্ট করে বলেন এখন একমাত্র গণমাধ্যমই তাকে ন্যায় বিচার এনে দিতে পারে।

 

চলচ্চিত্র জগতের একজন প্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রী হয়েও কোথাও তিনি সাহায্য-সহযোগীতা পাননি এবং বিচারও পাননি। শেষ পর্যন্ত তার প্রাপ্য ন্যায্য বিচারের জন্য গণমাধ্যমের দ্বারস্থ হতে হয়েছে এবং স্পষ্টভাবেই আমরা দেখতে পেয়েছি যে থানা প্রথমে মামলা নিতে না চাইলেও পরবর্তীতে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর তারা মামলা গ্রহণ করে এবং মামলা গ্রহণের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মামলায় অভিযুক্ত আসামীদের গ্রেফতার করা হয়। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসে কোথাও সাহায্য না পেলে গণমাধ্যমই কি শেষ আশ্রয়স্থল? আইনকে সঠিক পথে আনতে এবং তার কাজটি করার জন্য গণমাধ্যমকেই চাপ প্রয়োগ করতে হবে?

 

এ বিষয়ে আরটিভির উপ-বার্তা প্রধান মামুনুর রহমান খান বলেন, ‘বাংলাদেশের বাস্তবতায় তো বিষয়টা তো সেরকমই। এটাই গণমাধ্যমের শক্তির জায়গা। সম্প্রতি গণমাধ্যমের বিষয়ে অনেক অভিযোগ আছে, অনেক নেতিবাচক বিষয় আছে, অনেক ঘটনাতে গণমাধ্যমের অনেক সমালোচনা আছে। কিন্তু দিনশেষে গণমাধ্যমই সাধারণ মানুষের পাশে, বঞ্চিতদের পাশে বা নিগৃহীতদের পাশে দাঁড়ায়। আমি মনে করি এই ঘটনার মধ্য দিয়ে সেটাই আবারও প্রমাণ হলো। তিনি আরও বলেন, সব পেশাতেই ভালো-মন্দ আছে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে গণমাধ্যমেও অপব্যবহার নেই। তার পরেও মূলধারার গণমাধ্যম গুলো সবসময় চেষ্টা করে অপরাধীদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সে যতই শক্তিশালী হোক। পাশাপাশি বঞ্চিত-নিগৃহীতদের পাশে থাকতেও চেষ্টা করে গণমাধ্যম। পরীমনি সমাজে একজন প্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রী। তিনি নিজেই অবস্থাটা বুঝেছেন। গণমাধ্যমে তার বিষয়টি প্রচার হওয়ার পরই কিন্তু যে অবস্থাটা ছিল রাতারাতি তার একটা পরিবর্তন এসেছে। মামলা হয়েছে, অপরাধীরা ইতিমধ্যে গ্রেফতার হয়েছে, সারাদেশে একটা জনমত তৈরি হয়েছে। উনার একটা অভিযোগ ছিল যে, তিনি অনেকের সাহায্য চেয়ে পাননি। এখন দেখা যাচ্ছে তার পেশার অনেকেই তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। পুরো বিষয়টাই গণমাধ্যমের একটা ইতিবাচক ভুমিকা আমি দেখছি’।

 

নাগরিক টেলভিশনের বার্তা প্রধান দীপ আজাদ বলেন, এই বিষয়টা আজকের না বাংলাদেশের বাস্তবতায় পেছন ফিরে তাকালে স্পষ্টভাবেই দেখা যায় গণমাধ্যমই আসলে শেষ আশ্রয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে যারা সমাজের উঁচু স্তরে আছেন তারা অসহায় হয়েই গণমাধ্যমের কাছে আসেন। আইনের আশ্রয় পান না পাশাপাশি সমস্ত দ্বার যখন তাদের জন্য বন্ধ হয়ে যায় তখন একমাত্র গণমাধ্যমের দ্বারটি তাদের জন্য খোলা থাকে। সেই ক্ষেত্রে গণমাধ্যম তার সঠিক ভূমিকাটি পালন করে আইন কে তার পথে আনার চেষ্টা করে। গণমাধ্যম যখন সঠিকভাবে তার দায়িত্ব পালন করে তখন আইন তার নিজের কাজটি করতে বাধ্য হয়। সেটি পরীমনির ক্ষেত্রে আবারও একটি উদাহরণ হিসেবে দেখা গেল।

 

গণমাধ্যম কি শুধু সমাজের প্রতিষ্ঠিতদের পাশেই দাঁড়ায় নাকি সাধারণ মানুষের পাশেও সমানভাবে দাঁড়াতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তরে আরটিভির উপ-বার্তা প্রধান মামুনুর রহমান খান বলেন, প্রতিষ্ঠিতদের বিষয় গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার হয়। তাদের বিষয়ে সাধারণের আগ্রহ বেশি থাকে। যার ফলে তাদের সংবাদ গুলো বেশি দৃষ্টিগোচর হয় এবং এটা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। তবে সাধারণ মানুষের পাশে যে দাঁড়ায় না সেটাও বলা যাবে না। আবার উল্টো করে এটাও বলা যায় সবার পাশে যে দাঁড়ানো যায় সেটাও না। অনেক সময় এই বড় নাম গুলোর প্রতি বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া হয় সেটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তবে গণমাধ্যম সাধ্যমত চেষ্টা করে বঞ্চিতদের বিষয়গুলোকে সামনে নিয়ে আসতে।  

 

সব ঘটনাকেই সমানভাবে গুরুত্ব দিয়ে গণমাধ্যমের প্রকাশ করা উচিত উল্লেখ করে নাগরিক টেলভিশনের বার্তা প্রধান দীপ আজাদ বলেন, নিউজ আইটেম হিসেবে তারাকা বা সমাজে প্রতিষ্ঠিদের বিষয় গুলো একটু প্রথম দিকে থাকে। ঘটনা যখন সমাজের কোনো উঁচুস্তরের মানুষ নিয়ে বা কোনো সেলিব্রিটি নিয়ে অথবা বড় পদের কারও বিষয়ে হয় তখন গণমাধ্যমের কাছে এগুলো নিউজ আইটেম হিসেবে একটু বেশি কদর পায়। এর সাথে সাথে অনেক সময় আরও ঘটনা ঘটে যেটি আসলে গণমাধ্যমের চোখ এড়িয়ে যায় বা গণমাধ্যম হয়তো সেভাবে দৃষ্টি দেয় না। তবে সব ঘটনাকেই সমানভাবে গুরুত্ব দিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশ করা উচিত এবং গণমাধ্যমের দায়িত্বটি সঠিকভাবে পালন করা উচিত।

 

উল্লেখ্য, রবিবার ১৩ই জুন রাতে এক ফেইসবুক স্ট্যাটাসে ধর্ষণ ও হত্যা চেষ্টার অভিযোগ আনেন ঢাকাই সিনেমার জনপ্রিয় অভিনেত্রী পরীমনি। তার অভিযোগ ঢাকা বোট ক্লাবের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য (বিনোদন ও সংস্কৃতি) নাসির ইউ মাহমুদের বিরুদ্ধে।

চার দিন আগে উত্তরায় বোট ক্লাবে নাসির মাহমুদ তার উপর চড়াও হয়েছিলেন এবং তাকে ধর্ষণচেষ্টা ও হত্যাচেষ্টা  করেন বলে নিজ বাসায় ডাকা এক সংবাদ সম্মেলনে জানান এই অভিনেত্রী।

অভিযুক্ত নাসির ইউ মাহমুদ ঢাকা বোট ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং একজন আবাসন ব্যবসায়ী। উত্তরা ক্লাবের সাবেক সভাপতিও ছিলেন তিনি।

 

ঘটনার বিষয়ে রবিবার রাতে একটি ফেইসবুক স্ট্যাটাস দেন পরীমনি। সেই ফেইসবুক পোস্টে পরীমনি লিখেন, “আমি শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছি। আমাকে রেপ এবং হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে। আমি এর বিচার চাই।” সেই স্ট্যাটাসে তিনি বিচারের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

 

সংবাদ সম্মেলনে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ৯ই জুন বুধবার রাতে কস্টিউম ডিজাইনার জিমি ও জিমির বন্ধুসহ তারা উত্তরায় বোট ক্লাবে গিয়েছিলেন। এই সময় দুজন বয়স্ক ব্যক্তি এসে তাদের মদ পানের আমন্ত্রণ জানায়। তখন শরীর খারাপ বলে তাদের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন পরীমনি। পরীমনির ভাষ্যমতে ঐ দুজনের একজন নাসির মাহমুদ ছিলেন।

প্রত্যাখানের পরও জোরাজুরি করেন তারা। জোরাজুরির এক পর্যায়ে তাকে মারধর করে কিছু লোক। এসময় নাসির মাহমুদ তার মুখে জোরপূর্বক মদের বোতল ঠেসে ধরে গিলতে বাধ্য করেন এবং তখন তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করে।

 

সংবাদ সম্মেলন শেষে গণমাধ্যম কর্মীদের উদ্দেশ্যে পরীমনি বলেন, ‘এই আজকে আপনারা ইন্টারভিউ নিছেন আপনারা চলে যাবেন। কেউ কিন্তু বলতে পারছেন না আজকে রাতে আমি বাঁচব কি মরব! আমার নিরাপত্তা কি আপনারা দিতে পারবেন? আমি লাস্ট একটা কথা বলি আমি সুইসাইড করার মত মেয়ে না। আমি যদি মরে যাই আপনারা বুঝবেন আমাকে মেরে ফেলা হয়েছে। আমি সুইসাইড করতে পারি না, আমি সুইসাইড করব না। আমি আমার বিচার নিয়ে মরব। আমার সাথে অন্যায় করা হয়েছে। আমার সাথে হয়ে যাওয়া অন্যায়ের বিচার চাই আমি।’

 

সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের আচরণ এবং প্রশ্ন করার ধরণ নিয়েও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপাক আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এ বিষয়ে দীপ আজাদ বলেন, ‘আমাকে আগে বুঝতে হবে গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে আমার দৌড় কতটুকু, কোন জায়গা পর্যন্ত আমি যেতে পারি। গণমাধ্যমকর্মীদের একটা ব্যারিকেড আছে শেষ সীমা আছে। এগুলি সম্পর্কে সম্মখ ধারণা থাকা উচিত। আমরা গণমাধ্যম কর্মীরা এই শেষ সীমা সম্পর্কে জানিনা বলেই আমাদের যত নীতি-নৈতিকতা আছে সমস্ত কিছু আমরা ভেঙ্গে ফেলি। পরে সেটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। যখন কেউ খুন হয় বা মারা যায় আমরা তার বাচ্চাকে জিজ্ঞেস করি ঘটনার বর্ণনা দিতে। যখন কেউ ধর্ষণ হলো বা ধর্ষণের অবস্থা তৈরি হলো আমরা তাকে ঘটনার বর্ণনা দিতে বলি। পুরো ঘটনার খুঁটিনাটি বর্ণনা আমরা তার কাছ থেকে আশা করি। এই বিষয়গুলো সাংবাদিকতার নীতিমালায় কখনই সমর্থন করে না। বিশেষ করে আমাদের তরুণ যেসব গণমাধ্যম কর্মী এখন উঠে আসছেন তাদেরকে বিষয় গুলো সম্পর্কে হাউজ থেকে জানানো উচিত এবং তরুণ যারা সাংবাদিকতায় আসছেন তারা নিজেরাও এগুলো শিখে আসবেন’।