সাংবাদিকতার স্বাধীনতা নিয়ে সামাজিক যোগোযোগ মাধ্যমে ক্ষোভ


সাংবাদিকতার স্বাধীনতা নিয়ে সামাজিক যোগোযোগ মাধ্যমে ক্ষোভ

রাজধানীর গুলশানের একটি ফ্ল্যাট থেকে এক কলেজ শিক্ষার্থীর মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। এ ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়েছে বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরের বিরুদ্ধে। 

পুলিশ জানিয়েছেন, ২৬ এপ্রিল সোমবার রাতে ঐ কলেজ শিক্ষার্থীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তিনি সেই ফ্ল্যাটে একা থাকতেন। পরে আজ ভোরে রাজধানীর গুলশান থানায় ‘আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়া’র অভিযোগে বসুন্ধরার এমডির বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করা হয়।

এছাড়াও দায়ের হওয়া মামলার আসামি বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীরের বিদেশযাত্রার ওপর নিষেধাজ্ঞা চেয়ে মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আজ মঙ্গলবার আবেদন করেছে পুলিশ। আদালত পুলিশের আবেদন মঞ্জুর করেছেন।

এদিকে এরকম একটি ঘটনার পরেও অনেক গণমাধ্যম তাদের প্রতিবেদনে বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরের নাম ব্যবহার করেনি। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চাপের মুখে গণমাধ্যমগুলো। এ নিয়ে অনেকেই ক্ষোভ জানান।

আরেক সিনিয়র সাংবাদিক শরিফুল হাসান লিখেছেন,

“স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রতিবন্ধকতা হিসেবে আমরা প্রায়ই রাষ্ট্রীয় বাঁধার কথা বলি। কিন্তু রাষ্ট্রীয় বাঁধা তো অনেক পরের ঘটনা! বড় কোন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ এলেই আমাদের স্বাধীন সাংবাদিকতার আসল চিত্র বেরিয়ে পড়ে! এই যে একটা ঘটনা দেখেন, গুলশানের একটি ফ্ল্যাট থেকে মুনিয়া নামে এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। মুনিয়ার বাবা কুমিল্লার বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুর রহমান। পুলিশ ও পরিবার বলছে, মুনিয়া রোববার তাঁর বড় বোনকে ফোন করে বলেন, তিনি ঝামেলায় পড়েছেন। এই ফোন পেয়েই মুনিয়ার বড় বোন সোমবার কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আসেন। সন্ধ্যার দিকে গুলশানের ওই ফ্ল্যাটে যান তিনি। দরজায় ধাক্কাধাক্কি করলেও বোন দরজা খুলছিলেন না। এরও কিছুক্ষণ আগে থেকে বোনের ফোন বন্ধ পাচ্ছিলেন। পরে বাইরে থেকে ‘লক’ খুলে ঘরে ঢুকে বোনকে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলতে দেখেন। পরে তিনি বাড়িওয়ালাকে বিষয়টি জানান। তখন পুলিশে খবর দেওয়া হয়। গুলশান থানা পুলিশ বলছে, সিসি ক্যামেরার ফুটেজ এবং মুনিয়ার ব্যবহৃত ডিজিটাল ডিভাইসগুলো জব্দ করেছে। এ ঘটনায় মুনিয়ার নিহতের বড় বোন বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভিরের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন। কারও নাম আসা মানে এই নয় যে তিনি অপরাধী। পুলিশ তদন্ত করবে, বিচার হবে। সাংবাদিকরা লিখবে, অনুসন্ধান করবে। কিন্তু দেখেন এই ঘটনায় আসামির নাম শুনেই আটকে গেছে আমাদের স্বাধীন সাংবাদিকতা! অধিকাংশ গণমাধ্যম নিউজটাই করেনি। সেখানকার সম্পাদক বা শত শত সাংবাদিকের কারও এ নিয়ে টু শব্দ করার সাহস নেই। অন্যদিকে নিরপেক্ষ আর সাহসী সাংবাদিকতার দাবিদার বহু পত্রিকা দায়সারা ভাবে নিউজ করলেও আসামির নামটা লেখার সাহস করেনি। সেখানকার সাংবাদিকদেরও কিছু বলার নেই। অথচ দেখেন এই ঘটনা নিয়ে অনুসন্ধান হতে পারতো। এর আগে সাব্বির হত্যা মামলার কী হয়েছিল সেটার ফলোআপ হতে পারতো। এসব ক্ষমতাশালীদের অপরাধের বিচার শেষ পর্যন্ত কেন হয় না, বিচাররে নামে সরকারি-বেসরকারি লোকজন কার কী ভূমিকা, কে কতো টাকা ঘুষ নেয় সেগুলোও কিন্তু হারিয়ে যায়। আমি অনেকবার লিখেছি, বলেছি। আমার ১৮ বছরের কম-বেশি সাংবাদিকতায় অভিজ্ঞতায় জানি, রাষ্ট্র বা সরকার অনেক সময়েই স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। এটা পৃথিবীর সব দেশে কম-বেশি হয়। কিন্তু গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান সাথে থাকলে এই লড়াইয়ে ভয় পায় না সাংবাদিকরা। কিন্তু তারা ভয় পেতে বাধ্য হয় নিজের মালিক বা সম্পাদককে। কারণ, নিজের গণমাধ্যমের স্বার্থ যখন আসে, যখন সম্পাদক-মালিকের স্বার্থ আসে, তাদের পছন্দ-অপছন্দ আসে তখন কিন্তু থেমে যেতে হয় সাংবাদিককে। কারণ মালিক বা সম্পাদক না চাইলে তো কাজ করা সম্ভব নয়। কাজেই সম্পাদক বা মালিকের স্বার্থই আসল। কতো ধরনের স্বার্থ শুনবেন? ব্যবসায়িক স্বার্থ, বিজ্ঞাপনের স্বার্থ, ব্যবসার স্বার্থ, আত্মীয়তার স্বার্থ, সম্পাদকের ছেলের স্বার্থ, সম্পাদকের জামাইয়ের স্বার্থ, মালিকের স্বার্থ! আরও কতো কতো স্বার্থ যে আছে! আর এইসব স্বার্থের বলি হয় সাংবাদিকরা। আপনি টেরও পাবেন না সম্পাদক বা মালিক আপনাকে কতো ধরনের বিপদে ফেলে দেবে। আমি সংকটটাকে দুইভাগে ভাগ করবো এখানে। এক ধরনের গণমাধ্যম আছে যেখানে বেতন-বোনাস পাওনা ঠিকমতো দেওয়া হয় না। মালিক-সম্পাদকরা এখানে পত্রিকা বা গণমাধ্যেম চালান নিজের স্বার্থে। ইচ্ছে হলে তারা বেতন দেবেন, নয়তো না। আরেক ধরনের প্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে বেতন-বোনাসের সমস্যা ওতোটা নেই সেখানে সম্পাদক-মালিক তাদের স্বার্থবিরোধী কোন নিউজ ছাপবে না। আপনি দেখবেন, মালিক, সম্পাদক-সম্পাদকের ছেলে বা স্বজনেদর কারণে আপনার নিউজ ঠিকমতো, ছাপবে না, বিট বদলে যাবে, মানসিক অশান্তি তো আছেই! আপনি তখন হয় সাংবাদিকতা ছাড়বেন নয়তো প্রতিষ্ঠান। যেমনটা আমি করেছিলাম অভিমানে। আর কোন কারণে ছাড়তে না পারলে আপনি থাকবেন মানসিক অশান্তিতে। কাজেই মোটাদাগে যদি বলি, আমাদের দেশে সাংবাদিকতায় দুটি বড় প্রতিবন্ধকতা। একটা রাষ্ট্রের যেটা সবসময়ই কম বেশি ছিল। আরেকটা প্রতিষ্ঠানের। আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, এই দেশের সাংবাদিকরা বিশেষ করে যারা সৎ ও সাহসীভাবে সত্যিকারের সাংবাদিকতা করার স্বপ্ন নিয়ে এই পেশায় এসেছিলেন বা এখনো আছেন তারা কেউ ঝুঁকি নিতে ভয় পান না। কিন্তু প্রতিষ্ঠান অশান্তি তৈরি করলে আসলেই দিনে দিনে শক্তি হারিয়ে ফেলবেন। অন্যদিকে যারা অসৎ, যারা সম্পাদক বা মালিকের সাথে খাতির করে তাদের কিন্তু কোন সমস্যা নেই। অসৎ এই লোকদের ফ্লাট হবে, গাড়ি হবে, বাড়ি হবে। মালিক সম্পাদক আর তাদের স্বজনরাও ভাল থাকবে! এখানে কয়দিন কারও বিরুদ্ধে লেখা হবে, কিছুদিন পরেই আবার সেই প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন আসবে। এসব কারণেই আমি বলবো, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা মানে মালিক বা সম্পাদকের স্বাধীনতা না হয়ে সত্যিকারের সাংবাদিকতার স্বাধীনতা হওয়া উচিত। আমি মনে করি আমাদের সাংবাদিকতার এইসব সংকট নিয়ে একাডেমিক আলোচনা হওয়া উচিত। গণমাধ্যম যদি প্রতিষ্ঠান হিসেবে না গড়ে উঠে এই সংকট কখনো শেষ হবে না। শেষ করছি শুরুর কথাটা আবার বলে। এই দেশের স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র বা সরকার থেকে যতোটা না বাঁধা আসে তার চেয়ে অনেক বড় বাঁধা আসে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান থেকে। নানা স্বার্থে এখানে যে সেলফ সেনসরশিপ হয় সেটাই আজকের স্বাধীন সাংবাদিকতার সবচেয়ে বড় হুমকি।“

লেখক ও কলামিস্ট আফসান চৌধুরী লিখেছেন,

“গণ মাধ্যম এই লোকের নাম বলবে আর বিচার হবে ,তাই তো ? ক্ষমতার বিষয়টা ভালো ধরসে সুশীল সমাজ, বাকিরা হাইল্লা কিছু যায় আসে না..”

 

 

এছাড়াও অনেক সাধারন জনগনও এ নিয়ে ক্ষোভ জানায় সোস্যাল মিডিয়াতে, ইতি আফরোজ নামে একজন লিখেন, “গুলশানের ফ্ল্যাট থেকে যে মেয়েটির লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, তার নাম ঠিকানাসহ বাবা-বোনের নামও নিউজে উল্লেখ করা হচ্ছে কিন্তু যে লোকটার নামে মামলা হয়েছে তার নাম নিউজে লিখতে কী লজ্জা লাগছে! নাকি ভাসুরের নাম মুখে আনা মানা বিষয়টা এমন!! 'তিনি দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপের এমডি' এটা কীভাবে একজন মানুষের পরিচয় হয়! ”

 

 

তবে এইরকম ক্ষোভের পরে বেশীরভাগ শীর্ষ স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরের নাম ব্যবহার করে সংবাদ প্রচার করে।