সাংবাদিক জামিল উদ্ধার


সাংবাদিক জামিল উদ্ধার

সাংবাদিক সিয়াম সারোয়ার জামিলকে ঢাকার সাভার থেকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার (২৩ এপ্রিল) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে সাভারের আশুলিয়ায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশ থেকে তাকে আহত ও হাত বাঁধা অবস্থায় খুঁজে পান স্থানীয় কাঠমিস্ত্রি মো. জাহাঙ্গীর। সিয়াম সারোয়ার তার পরিচয় দিলে জাহাঙ্গীর তার পরিচিত স্থানীয় সাংবাদিক মো. ইয়াসিমকে ডেকে আনেন। তিনি এসে সব শুনে সিয়ামকে কথা বলিয়ে দেন তার স্বজনদের সঙ্গে।
পরে তাকে ধামরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। সেখানে তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে রাতেই ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। তিনি বর্তমানে পান্থপথের হেলথ এন্ড হোপ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছেন।  অপহরণকারীরা তার কাছ কাছে থাকা মোবাইল, ঘড়ি ও নগদ টাকাসহ মানিব্যাগ নিয়ে গেছে।গেলো বৃহস্পতিবার (২২ এপ্রিল) সকাল সাড়ে ৬টার দিকে বনানীর বিটিসিএল কলোনির নিজের বাসা থেকে বের হয়ে পশ্চিম নাখাল পাড়ায় বড়বোনের বাসায় যান সিয়াম। সেখান থেকে

সকাল ১০টার দিকে বের হন। তারপর তার আর খোঁজ মিলছিল না ।মোবাইল ফোনটিও বন্ধ ছিল। শুক্রবার দুপুরে সিয়াম সারোয়ার জামিলের সন্ধান চেয়ে তার স্ত্রী শারমীন সুলতানা তেজগাঁও থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করেছিলেন।
নিখোঁজ হওয়ার আগে বৃহস্পতিবার সকাল সাতটার দিকে তিনি লেখেন, ‘পৃথিবীটা ভীষণ সুন্দর। আর মানুষও। সবাইকে সালাম। ভালো থাকবেন।

সিয়াম সারোয়ার নেপালের সংবাদমাধ্যম কাঠমান্ডু ট্রিবিউনের বাংলাদেশ ব্যুরোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক এবং যুব ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক। তিনি বেসরকারী চ্যানেল আরটিভি তে ও সাংবাদিক হিসাবে দীর্ঘ দিন কাজ করেছেন । এছাড়াও তিনি কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সহকারী সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সহ-সভাপতি ছিলেন। 

অপহরণের ঘটনা যেভাবে
সাংবাদিক ও বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত সিয়াম সারোয়ার জামিল উদ্ধারের পর জানান, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তাকে চার থেকে পাঁচজন মিলে অপহরণ করেছিল। এরপর একটি গাড়িতে করে তাকে সেদিন রাতে পরদিন সারাদিন ঘোরানো হয়।
সিয়াম বলেন, ‘গত পরশু সন্ধ্যার সময় আমিনবাজার ব্রিজের পাশে ফাঁকা জায়গাটায় আমি হাঁটছিলাম। ওই সময় আমার হাতে থাকা ফোন একজন টেনে নিয়ে যায়। তাৎক্ষণিকভাবে আরও দুজন পেছন থেকে আমাকে ধরে এবং ওই পরিস্থিতিতে আমাকে জোরপূর্বক মাটিতে ফেলে দেয়। তার কিছুক্ষণ পরে চোখও বেঁধে দেয়।’
এ সময় একটা গাড়ি আসে সেই গাড়িতে তাকে উঠিয়ে নেয়া হয়, ‘তারপরে ঐখান থেকে রাতে ঐ গাড়িতেই রেখে দেয়া হয়েছিল আমাকে। সেইখানে আমাকে এক বেলা খাবার দেয়া হয়েছে।’
অপহরণকারীদের একজন উচ্চশিক্ষিত ছিলেন। পুরো সময়টায় একজন ‘মোটামুটি উচ্চশিক্ষিত’ লোকের উপস্থিতি টের পেয়েছেন সিয়াম। জানান, তিনি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন। সেই ব্যক্তি তাকে শারীরিক নির্যাতন করেন।
সিয়াম বলেন, ‘আমি যেটুকু সিওর সে লংটাইম ধরে আমাকে চেনে এরকম একজন ব্যক্তি ছিল এবং তার মুখে ফেনী নোয়াখালী বা চাটগাঁইয়া উচ্চারণটা ছিল।’
কাউকে চিনতে পেরেছেন কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এদের কাউকে আমি চিনতে পারি নাই। ওদের চারজনের মধ্যে একজন আমাকে চিনতে পেরেছিল এবং ওরা রাতভর ঘুরছে। হঠাৎ আমি শুনতে পারি যে, আরে আমরা তো কেরানিগঞ্জ চলে আসলাম।’
সিয়ামের ধারণা এটা আলম নগরের পাশ দিয়ে শামলাপুর দিয়ে যে কেরানিগঞ্জের রাস্তাটা গেছে, সেদিক দিয়ে তারা ঢুকেছেন। পরে সেখান থেকে এসে আবার ঘুরিয়ে শেষে হাফিজ উদ্দিন কলেজের (আশুলিয়ার নিরিবিলি) নির্জন গলিতে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।
ফেলে যাবার সময় হুমকি দেয় অপহরণকারীরা। তিনি জানান, গাড়ি থেকে নামানোর সময় তাকে বসে থাকতে বলা হয়েছে।
বলেন, ‘আমাকে বলেছে যে, ঐ তালগাছগুলার পাশে এখানে বসে থাকবি। ১০ মিনিট পর্যন্ত এখান থেকে উঠবি না। না হলে গুলি করে দেব।’
সিয়াম বলেন, ‘আমি ১০ মিনিট শুয়ে ছিলাম। তারপরে ওখান থেকে উঠে হাঁটতে শুরু করি। হাঁটতে হাঁটতে কিছুক্ষণ পরে একজন সহৃদয়ের মানুষ তিনি আমাকে সাহায্য করেন। আমার হাতের বাঁধন খুলে দেন ’
পরে সেই ব্যক্তি পুরো এলাকাটা ঘুরে দেখে জানান, যারা তাকে নিয়ে এসেছিলেন কেউই নেই। এরপর অনেকটা নির্ভার হন সিয়াম। তখন বাসায় ফোন করে তার অবস্থান পরিবারের সদস্য ও বন্ধুদের জানান।
কারও সঙ্গে কোনো শত্রুতা ছিল কি না এই প্রশ্নে উত্তরে সিয়াম বলেন, ‘আমি আরটিভিতে দীর্ঘ দিন কাজ করেছি। আমি এখন নেপালভিত্তিক কাঠমান্ডু টিব্রিউনে কাজ করি। এই পরিস্থিতিতে লিগ্যালি আমার সঙ্গে আসলে রেগুলার কনভারসেশনে ঝামেলা হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।’
সিয়াম বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এক সময় তিনি ছিলেন ঢাকা জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সভাপতি ও কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের সহকারী সাধারণ সম্পাদক।
সিয়াম বলেন, ‘আমি দীর্ঘ সময় ছাত্র রাজনীতি করেছি। ফলে সেই পারপাসে হতে পারে।’সাংগঠনিক নানা বিষয় নিয়ে কয়েকজনের সঙ্গে মনোমালিন্য হয়েছিল। তবে এ কারণে এই অপহরণের মতো ঘটনা ঘটবে বলে বিশ্বাস করেন না তিনি।
যা জানিয়েছেন উদ্ধারকারীরা
উদ্ধারকারী কাঠমিস্ত্রী মো. জাহাঙ্গীর ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘উনি হাঁটতে হাঁটতে এসে আমারে বলছে ভাই আমার হাতের বানটা একটু খুল দিবেন?
‘আমি বললাম আপনি কে? উনি বলল, আমারে এখানে বাঁইধা রাখছে। আমি কইলাম কেডা? কয়, ওইযে পাশের লোকেরা। পরে আমি সাথে সাথে গেছি দেখতে। গিয়ে দেখি লোকগুলা নাই।’
তিনি বলেন, ‘পরে আরেকজন মুরুব্বির ডাইকা বলছি ওনারে চেনেন? আবার উনি বলছে যে উনি না কি সাংবাদিক। তখন আমাদের এখানের সাংবাদিক ইয়াসিন ভাইরে ডাইকা আনছি। উনি আবার ওনারে স্যালাইন, পানি খাওয়াইছে।’
স্থানীয় সাংবাদিক মো. ইয়াসিন বলেন, ‘পরিচিত ওই কাঠমিস্ত্রি ঐ ব্যক্তিকে উদ্ধার করে আমার কাছে নিয়ে আসে। তখন উনি আমাকে বলল যে উনি সাংবাদিক। তখন উনার কাছে জানতে পারলাম যে উনি ঢাকাতে কর্মরত আছেন। পরে আমি এখানকার স্থানীয় সাংবাদিকদের জানালাম, তারাও আসলো। ওনার পরিচিত আত্মীয়স্বজনও আসলো। পরে ওনাকে নিয়ে তারা ধামরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেল।’
উদ্ধারের পর সিয়ামকে পাশের ধামরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হয়। সেখানের চিকিৎসক নূর রিফফাত আরা বলেন, ‘আমরা ধারণা করছি, অসুস্থ ঐ সাংবাদিককে চেতনানাশক কিছু খাওয়ানো হয়েছে। এছাড়া শরীরে অসংখ্য ব্লেডের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তার শারীরিকক অবস্থা বেশি ভালো না।’
স্বজনরা সিয়ামকে সেই হাসপাতালে রাখতে চাননি। তাই সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে রাতেই ঢাকায় নিয়ে আসা হয়।
স্ট্যাটাসের কারণ 
নিখোঁজ হওয়ার আগে ফেসবুকে দেয়া স্ট্যাটাস নিয়েও ব্যাপক আলোচনা হয়েছে তার স্ত্রীর করা সাধারণ ডায়েরির পর।
বৃহস্পতিবার(২২ এপ্রিল) সকাল সাতটার দিকে তিনি লেখেন, ‘পৃথিবীটা ভীষণ সুন্দর। আর মানুষও। সবাইকে সালাম। ভালো থাকবেন।’ আর ১০টার দিকে তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না বলে শুক্রবার দুপুরে তেজগাঁও থানায় করা সাধারণ ডায়েরিতে উল্লেখ করেন স্ত্রী শারমীন সুলতানা।
সেই স্ট্যাটাস নিয়ে সিয়াম বলেন, ‘স্পেশাল কোনো কারণ না। সকাল বেলাটা আমার কাছে মনে হইছে যে সকালটা খুব সুন্দর। সেই জায়গা থেকে একটা পজিটিভ ইমেজ নিয়ে আমি ওটা দিয়েছি এবং সবার ভালো থাকার প্রত্যাশাও করছি। এটার সাথে অন্য কোনো চিন্তা ভাবনা করার কোন সুযোগ নাই এবং পরবর্তীকালে আমি দেখলাম যে ফোনের চার্জও কম। ওই সময়কালে আর কোনো কিছুর করার সুযোগ ছিল না।’
‘আমার মন খারাপও ছিল কয়েক দিন ধরে। তো আমি ভাবলাম যে আজকে অফিস না যাই। আমি একটু নদীটা উপভোগ করি। নদীর প্রতি আমার একটা ভালোবাসা আছে। তো আমি ওই আমিনবাজার ব্রিজটা পার হয়ে নদীর ঘাট, নদীর কাজকর্ম এগুলাই দেখছিলাম।’সেই সময়ই এই ঘটনা ঘটে বলে জানান এই সাংবাদিক।