শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের জন্মদিন আজ


শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের জন্মদিন আজ

সেলিনা পারভীন

আজ ৩১ মার্চ জাতির সূর্য সন্তান, নির্ভীক কলমসৈনিক সেলিনা পারভীনের ৯০তম জন্মদিন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৩ ডিসেম্বর আল বদর বাহিনী তাঁকে অপহরণ করে নিয়ে যায় ও হত্যা করে। স্বাধীনতার পর রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে সেলিনা পারভীনের মৃতদেহ পাওয়া যায়।

সেলিনা পারভীন সাপ্তাহিক বেগম, সাপ্তাহিক ললনা, ও শিলালিপি পত্রিকায় সম্পাদক ছিলেন। তাঁর জন্ম ১৯৩১ সালে, ফেনীতে। তাঁর বাবা আবিদুর রহমান ছিলেন একজন শিক্ষক। ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময়ই সেলিনা পারভীন সাহিত্যের অনুরাগী হয়ে গল্প ও কবিতা লেখা শুরু করেন। কিন্তু গ্রামীণ কুসংস্কারের মারপ্যাঁচে তাঁর পড়ালেখার সাময়িক বন্ধ হয়ে যায়। এরপর মাত্র ১৪ বছর বয়সে বিয়ে এবং সংসার ভেঙে যাওয়া- সব  মিলিয়ে পড়াশোনায় বেশিদুর এগোতে পারেননি সেলিনা পারভীন। 

১৯৪৫ সাল থেকেই তিনি লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫৮ সালে তিনি ঢাকা আসেন। এ সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের পরিচালকের দায়িত্ব পান। পরের বছর কর্তৃপক্ষের সাথে মতের অমিল হওয়ায় তিনি সেই চাকরি ছেড়ে দেন । 

এ সময় সাপ্তাহিক ললনা পত্রিকার  বিজ্ঞাপন বিভাগে কাজ শুরু করেন। বিজ্ঞাপন সংগ্রহ, টাকা তোলা সব কাজ একাই করতেন সেলিনা পারভীন। তবে পত্রিকা অফিস থেকে অনেক সময় বেতনই পেতেন না। তবুও বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ১৯৬৯ শিলালিপি নামে একটি পত্রিকা বের করেন। এটি তিনি নিজেই এটি সম্পাদনা ও প্রকাশনার দায়িত্বে ছিলেন। 

শিলালিপি ছিল সেলিনার নিজের সন্তানের মত। দেশের প্রায় সব বুদ্ধিজীবীর লেখা নিয়ে প্রকাশিত শিলালিপি এক সময় সবারই নজর কাড়লো। স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করতো শিলালিপি। 

১৯৬৯-এর রাজনৈতিক আন্দোলনের উত্তাল বাংলাদেশ। নিজেও সক্রিয় হন গণঅভ্যুত্থানের আন্দোলনের সঙ্গে। এলো ১৯৭১। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় চারিদিকে তখন চলছে আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণ, প্রতিরোধ। চারপাশে শুধু বুলেটের শব্দ আর বারুদের গন্ধ, চিৎকার, গোঙানি, রক্তস্রোত আর মৃত্যু। সেলিনা পারভীন স্থানীয় তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার, ঔষধ, কাপড় আর টাকা দিয়ে সহযোগিতা করতে শুরু করেন। শিলালিপি বিক্রির টাকা দিয়েই মূলত তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতেন। 

এরইমধ্যে প্রায় বন্ধ হয়ে যেতে বসলো সাপ্তাহিক ললনা। শিলালিপির উপরও নেমে এলো পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর খড়গ। হাসেম খানের প্রচ্ছদ করা শিলালিপির একটি প্রকাশিতব্য সংখ্যা নিষিদ্ধ করে দেয় পাকিস্তান সরকার।

পরে অবশ্য প্রকাশের অনুমতি মিললো, তবে শর্ত হলো নতুনভাবে সাজাতে হবে। সেলিনা পারভীন বরাবরের মতো প্রচ্ছদ না নিয়ে তাঁর ভাইয়ের ছেলের ছবি দিয়ে প্রচ্ছদ করে আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে শিলালিপির সর্বশেষ সংখ্যা বের করেন। যেটাতে ছিল দেশ বরেণ্য বুদ্ধীজীবীদের লেখা এবং স্বাধীনতার পক্ষের লেখা। আর সেটিই তাঁর জীবনের কাল হলো। এই সংখ্যার জন্যই সেলিনা পারভীন পাকিস্তানী ও দালালদের নজরে পড়ে যান। 

শিলালিপির আরেকটি সংখ্যা বের করার আগে নিজেই হারিয়ে গেলেন সেলিনা পারভীন। ১৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সাল। সাংবাদিক সেলিনা পারভীন তখন বাস করতেন সিদ্ধেশ্বরীতে। মা, ছেলে সুমন, আর ভাইকে নিয়ে থাকতেন ১১৫ নম্বর নিউ সার্কুলার রোডে তাঁর বাড়িতে। শহরে তখন কারফিউ, রাস্তায় মিলিটারি। সেদিন সেলিনা লিখছিলেন। এমন সময় তাঁর দরজায় কড়া নাড়ে কিছু লোক। তাদের মুখ রুমাল দিয়ে ঢাকা ছিল এবং সবার পরনে ছিল একই রঙের পোশাক। সেলিনা পারভীন নিজে দরজা খুলে দেন। পরিচয় নিশ্চিত হয়ে সেলিনা পারভীনকে গামছা দিয়ে চোখ ও হাত পিছমোড়া করে বেঁধে নিয়ে যায় সেই আল বদররা। তিনি আর ফিরে আসেননি। 

১৪ ডিসেম্বর আরও অনেক বুদ্ধিজীবীর মতো পাকিস্তানের দালাল আলবদর বাহিনীর ঘৃণিত নরপশুরা সেলিনা পারভীনকে হত্যা করে। তাঁর সারা শরীরে ছিল নির্মম অত্যাচারের চিহ্ন। চেহারা এমনভাবে বিকৃত করেছিল যে তাকে চেনার উপায় ছিল না। চোখ বাঁধা ক্ষতবিক্ষত লাশ পড়ে ছিল রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে। শীতকাতুরে সেলিনার পায়ে তখনো পরা ছিল সাদা মোজা। এটি দেখেই পরে তাঁকে শনাক্ত করা হয়। 

১৬ ডিসেম্বর এই দেশে লাল-সবুজ পতাকা উড়েছিল। শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সেই আলোয় রাঙা ভোর দেখে যেতে পারেননি। কিন্তু এই পতাকার লাল বৃত্তের মাঝে লাখো শহীদের রক্তের সঙ্গে তাঁর রক্তের দাগও মিশে আছে। আজ ৩১ মার্চ শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভিনের জন্মদিন। আজকের দিনে বিজেসি নিউজ পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে এই কলম যোদ্ধাকে।