৪৮ ঘন্টা থেকে ৯ বছর এবং চলছে..


৪৮ ঘন্টা থেকে ৯ বছর এবং চলছে..

৯ বছরে ৭৯ বার পেছালো সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির তদন্ত প্রতিবেদন। তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার নতুন তারিখ ধার্য করা হয়েছে ২১ এপ্রিল। 

আজ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা থাকলেও দাখিল করেনি তদন্তের দায়িত্বে থাকা র‍্যাব। ঢাকা ম্যাট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রাজেশ চৌধুরীর আদালত নতুন এ দিন ধার্য করেন। 

 

হত্যাকান্ড 

দেশি- বিদেশী একাধিক গণমাধ্যমে কাজ করেছেন সাংবাদিক সাগর সরওয়ার। ২০১১ সালে মাছরাঙ্গা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন। সাগরের স্ত্রী মেহেরুন রুনী কাজ করেছেন বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে। স্বামীর সাথে ২০১১ সালে জার্মানী থেকে দেশে ফিরে যোগ দেন কর্মস্থল এটিএন বাংলায়। সেখানে তিনি কাজ করতেন সিনিয়র প্রতিবেদক হিসেবে। রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে একমাত্র পুত্র মাহির সরওয়ার মেঘকে নিয়ে একটি ভাড়া বাসায় বাস করতেন এই সাংবাদিক দম্পতি। 

২০১২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি রাতে কাজ শেষে নিজ বাসাতেই ফিরে এসেছিলেন এই সাংবাদিক দম্পতি। ১১ ফেব্রুয়ারি ভোর বেলা সেই ভাড়া বাসা থেকে সাগর-রুনির ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। দুটো ল্যাপটপ আর মোবাইল ফোন ছাড়া বাসা থেকে হারায়নি আর কিছুই। প্রাণে বেঁচে যায় তাদের একমাত্র সন্তান মাহির সরওয়ার। ঘটনার পর রুনির ভাই নওশের আলম রোমান শেরেবাংলা নগর থানায় হত্যা মামলা করেন। 

হত্যার রহস্য কী? 

যেহেতু সাগর সরওয়ারের ব্যক্তিগত ল্যাপটপ এবং মোবাইল ছাড়া আর কিছুই হারায়নি স্বভাবতই রহস্যের শুরু থেকেই সেই ল্যাপটপ। হত্যাকান্ডের পর নয় বছর পেরিয়ে গেলেও ল্যাপটপ দুটোর কোন সুরাহা করতে পারেনি তদন্তকারীরা। কিন্তু কী ছিল ঐ ল্যাপটপে? কিছুটা জানা গিয়েছিল সাগর সরওয়ারের বন্ধু রফিকুল বাসারের কাছে। সংবাদ মাধ্যম ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, “সাগর ভাই নিহত হওয়ার ঠিক চার দিন আগে আমার সঙ্গে তাঁর লম্বা সময় আলোচনা হয়েছে৷ আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল তাঁর একটি বই৷ এর আগে ‘সাম্প্রতিক' থেকে সাগর ভাইয়ের একটি বই বের হয়েছে৷ বইয়ের নাম ‘কর্ণেলকে আমি মনে রেখেছি'৷ চার দিন আগের ঐ আলোচনায় সাগর ভাই আমাকে বলেন যে, বইটির পরবর্তী সংস্করণের লেখা তাঁর শেষ হয়েছে৷ এবারের বইমেলাতেই বইটা বের করতে চান তিনি”৷ 

পার্বত্য এলাকার আদিবাসীদের নিয়ে লেখা সেই বইয়ের পরবর্তী সংস্করণের পাণ্ডুলিপি ছিল সেখানে। এছাড়া একটি ল্যাপটপে নিয়মিত ডায়রি ও ব্লগ লিখতেন তিনি। আরেকটি ছোট ল্যাপটপ সবসময় সঙ্গে রাখতেন সাগর সরওয়ার। নিজের করা পূর্বের রিপোর্ট এবং নতুন পাওয়া সকল তথ্যও সেখানে টুকে রাখতেন বলে জানা যায়। 

৪৮ ঘন্টা থেকে ৯ বছর এবং চলছে... 

১১ ফেব্রুয়ারি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনের ঘোষণা দেন। শেরেবাংলা নগর থানার মাধ্যমে তদন্ত শুরু হয়। দু'দিন পর তৎকালীন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার জানান, 'প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি' হয়েছে। কী অগ্রগতি হয়েছিল তা এখনো অজানা। চারদিনের মাথায় তদন্তের দায়ভার দেয়া হয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশকে। ৬২ দিন পর ডিবি পুলিশ কোন সুরাহা করতে না পেরে ব্যর্থতা স্বীকার করে। উচ্চ আদালতের নির্দেশে ১৮ই এপ্রিল ২০১২ তারিখে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় র‍্যাবের ওপর। দায়িত্ব পেয়েই সে বছরের ২৬শে এপ্রিল র‍্যাব ভিসেরা পরীক্ষার জন্য কবর থেকে সাগর-রুনির লাশ উত্তোলন করে। পরীক্ষা শেষে জানা যায় তাঁদের মৃত্যুর আগে কোনো প্রকার বিষাক্ত বা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করানো হয়নি। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে ছুরিকাঘাতে রক্তক্ষরণ ও আঘাতের কারণে তাঁদের মৃত্যু হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। 

সেসময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে আসা মহীউদ্দীন খান আলমগীর ২০১২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ঘোষণা দেন ১০ অক্টোবরের মধ্যেই রহস্য উদ্ঘাটন হবে। ৯ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলনে একজনকে ধরতে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন। সে ব্যক্তিকে গ্রেফতারও করা হয়। কিন্তু রহস্য রহস্যই থেকে যায়। 

২০১৫ সালের ৭ জুন র‍্যাব কিছুটা অগ্রগতির কথা জানায়। আদালতে দেয়া প্রতিবেদনে তারা জানান ঘটনাস্থল থেকে জব্দ করা আলামত যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়ে ফরেনসিক ও রাসায়নিক পরীক্ষার পর সেখান থেকে দুজন অজ্ঞাত পুরুষের পূর্ণাঙ্গ ডিএনএ বৃত্তান্ত পাওয়া গেছে। 

২০২১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি র‍্যাবের মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, “তারা মামলাটির তদন্তকাজ শেষ করতে কঠোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত এই মামলায় ১৬০ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে। ডিএনএ পরীক্ষার জন্য ২৫ জনের নমুনাসহ আরও কিছু প্রমাণাদি যুক্তরাষ্ট্রের একটি ল্যাবে পাঠিয়েছিলাম, সে প্রতিবেদন পেয়েছি। ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তির মুখের কাঠামো আঁকা যায়। তদন্ত কর্মকর্তা তা নিয়েই কাজ করছেন”। 

আসামী সন্দেহে গ্রেফতার নাকি জজ মিয়া নাটক? 

সাগর-রুনি হত্যা মামলায় এখনও পর্যন্ত ৮ জনকে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাঁরা হলেন রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মো. সাইদ, মিন্টু, কামরুল হাসান ওরফে অরুণ, সাগর-রুনির ভাড়া বাসার নিরাপত্তা প্রহরী এনামুল, পলাশ রুদ্র পাল এবং নিহত দম্পতির বন্ধু তানভীর রহমান। গ্রেফতারকৃতদের মধ্য প্রথম পাঁচজনকে বনানী থানার একটি হত্যা ও ডাকাতি মামলায় আগেই গ্রেফতার করা হয়েছিল। তানভীর ও পলাশ বর্তমানে জামিনে রয়েছেন। 

ব়্যাব গ্রেফতারকৃতদের বলছে সন্দেহভাজন আর পরিবার মনে করছে ‘জজ মিয়া’ নাটক। সাগর সরওয়ারের মা সালেহা মনির বলছেন, “অনেক লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের বিচার তো হচ্ছে। তাহলে সাগর-রুনি হত্যা মামলা নিয়ে সমস্যা কোথায়? ৯ বছর হয়ে গেল, আসলে কী যে হচ্ছে, নাটক নাকি চোর-পুলিশ খেলা? বুঝতে পারছি না”। তিনি মনে করেন হত্যাকান্ডের এক বছর পর দারোয়ান এনামুলকে গ্রেফতার করে জজ মিয়া নাটক সাজানো হয়েছে।