বাড়ছে চ্যানেল কমছে মান


বাড়ছে চ্যানেল কমছে মান

সরকার অনুমোদনকৃত বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের সংখ্যা ৪৫টি হলেও ৩০ টি চ্যানেল সম্প্রচারে আছে বলে জানা গেছে তথ্য মন্ত্রণালইয়ের সূত্রে। এছাড়া বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত সারাদেশে নিবন্ধনকৃত পত্র-পত্রিকার সংখ্যা ৩২১০টি। এর সাথে রয়েছে রেডিও এবং অনলাইন সংবাদ মাধ্যম। ২০১৮ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত অনলাইন পত্রিকা হিসেবে নিবন্ধনের আবেদন এসেছিল ২০১৮টি। প্রশ্ন হচ্ছে অল্প আয়তনের ছোট্ট এই দেশটিতে এতো সংবাদ মাধ্যমের প্রয়োজন আছে কি?

সম্প্রতি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ -ইউল্যাব ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশনা সংস্থা আইজিআই গ্লোবালের উদ্যোগে একটি গবেষণা পরিচালিত হয়েছে। গবেষণায় অংশ নিয়েছেন বাংলাদেশের সংবাদপত্র, স্যাটেলাইট টেলিভিশন ও অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোতে কর্মরত গণমাধ্যম কর্মীরা। সেখানে দেখা যাচ্ছে প্রায় ৪২.৯ শতাংশ সাংবাদিক তার পেশা নিয়ে কোনো না কোনো ভাবে বিষন্নতায় ভুগছেন। এছাড়াও ৭১.০৭ শতাংশ সাংবাদিক এই পেশা ছেড়ে দিতে চান।

করোনার মধ্যে সংবাদকর্মীদের একটি অংশকে চাকুরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। ইউল্যাব ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশনা সংস্থা আইজিআই গ্লোবালের পরিচালিত গবেষণাতেও দেখা যাচ্ছে পেশাগত বিষন্নতায় ভোগা সাংবাদিকদের প্রায় ৮৫ শতাংশই তাদের চাকুরি নিয়ে থাকেন অনিশ্চয়তায়।

টেলিভিশনের দর্শকের পরিমাণ দিনদিন হ্রাস পাচ্ছে এ খবরও বেশ পুরোনো। দেশি চ্যানেলের চাইতেও বিদেশী চ্যানেল দেখার প্রবণতা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই অবস্থাতেও আসছে নতুন নতুন চ্যানেলের অনুমোদন। বেসরকারি ৪৫টি টেলিভিশন চ্যালেনের বাইরেও ছাড়পত্র পেতে যাচ্ছে আরও বেশ কিছু নতুন চ্যানেল।

ছোট্ট আয়তনের এই দেশে যেখানে দর্শকপ্রিয়তা হারাচ্ছে টেলিভিশনগুলো অন্যদিকে বিষন্নতায় ভুগছেন সংবাদমাধ্যমের সংবাদকর্মীরা। এমন অবস্থায় নতুন নতুন টেলিভিশন ও সংবাদপত্রের প্রয়োজনীয়তা কতখানি এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. নাদির জুনাইদ বলেন, “টেলিভিশন চ্যানেলে এমন অনুষ্ঠান থাকা উচিত যা মানুষের চিন্তাশীলতাকে মজবুত করবে। আমাদের মূল ধারার টেলিভিশন মিডিয়ারতে চিন্তাশীলতার বিকাশ ঘটাবে এমন অনুষ্ঠান প্রচার কমে গেছে। শহরের বাইরে গ্রামে-গঞ্জে মানুষ এখনও ইন্টারনেটের সঠিক ব্যবহার করতে পারছে না ফলে টেলিভিশন দেখছে। কিন্তু অনুষ্ঠানের মান ভালো না হওয়াতে তারা দেশের ইতিহাস, রাজনৈতিক ইতিহাস, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সম্পর্কে তেমন জানতে পারছে না।

অধ্যাপক ড. নাদির জুনাইদ

বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবছর শিক্ষার্থীরা ভর্তি হচ্ছে কিন্তু তাদের এসব নিয়ে ধারণা খুবই কম। একই সাথে ভালো নাটক কিংবা চলচ্চিত্র প্রচার না হওয়াতে মানুষের মধ্যে সচেতন চিন্তার জায়গাটাও অনেকখানি কমে যাচ্ছে। গ্রামের দর্শকদের যদি ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’, ‘মাটির ময়না’, সত্যজিতের ‘পথের পাঁচালি’, জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’র মতো চলচ্চিত্র মাসে অন্তত একবারও দেখানো হতো তাহলে সেটা কিন্তু আমাদের রুচির গঠন এবং সচেতনতা তৈরিতে ভূমিকা রাখতো। এখন বর্তমানে দর্শকের আকর্ষণ করতে যেসব অনুষ্ঠান প্রচারিত হচ্ছে তারমধ্যে হালকা ধাঁচের বিনোদন লক্ষ্য করা যাচ্ছে যার ফলে এতো এতো টেলিভিশন থাকলেও মানুষের চিন্তার গুণগত পরিবর্তন হচ্ছে না। আবার সামাজিক যোগাযাগ মাধ্যম বর্তমানে টেলিভিশন এবং পত্র-পত্রিকাকেও হুমকির মুখে ফেলছে। শহরের মানুষ বর্তমানে অনলাইনে বিভিন্ন দেশের নাটক-চলচ্চিত্র দেখতে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠছে”।

কর্মসংস্থানের প্রশ্নে তিনি বলেন “এখন যারা সাংবাদিকরা আছেন তারাই ঠিকমতো বেতন ভাতা পাচ্ছে না। অনেক জায়গায় করোনায় তারা তাদের কর্মসংস্থান হারিয়েছে। আবার বেতনের পরিমাণ এতো কম তা দিয়ে তাদের সংসার ঠিক মতো চলছে না। এই অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে কেউ সাংবাদিক হতে চাইবে না। শুধুমাত্র বিসিএস’ই দেশের একমাত্র চাকরি হয়ে গেলে তো চলবে না। সরকারী চাকরির বাইরে সাংবাদিকতার মতো যেসব বেসরকারী গুরুত্বপূর্ণ খাত রয়েছে সে জায়গায় সরকারের মনোযোগ দেয়া খুবই জরুরী। শুধুমাত্র বিসিএস দিয়েই দেশ চলে না, সরকারি-বেসরকারি সকল খাতের সম্মিলিত অবদান দিয়েই দেশ চলে। তাই এসব খাতকেও যথাযথ সম্মান এবং গুরুত্ব দিতে হবে। আগে তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, শহীদুল্লাহ কায়সার, কামাল লোহানীদের মতো লোকজন সাংবাদিকতায় আসতো কিন্তু বর্তমানে যে অবস্থা চলছে তাতে সাংবাদিকতা পেশাটাই তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে”। 

নতুন যেসব টেলিভিশন চ্যানেল আসছে সেসব চ্যানেলগুলো বর্তমানের সস্তা ধাঁচের বিনোদন প্রচারের বাইরে গিয়ে সিরিয়াস অনুষ্ঠান প্রচার করবে কিনা এমন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, “গণমাধ্যম শুধু বিনোদন দেবে না, তারা একইসাথে মানুষকে শিক্ষিত করবে, রুচিশীল করবে সচেতন করবে। মুখে অনেক চেতনার কথা বলা হলেও ক্লাসরুমে আমরা তার কোন বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাচ্ছি না। আজকাল সংবাদপত্র-বই পড়ার চর্চা হারিয়েই গেছে। মানুষ টেলিভিশনই বেশি দেখছে। সেখানে যদি দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য সঠিকভাবে তুলে ধরা হতো তাহলে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হতো। আমি দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছি এবং সেই অভিজ্ঞতা থেকেই দেখতে পাচ্ছি ১৫ বছর আগেও তরুণদের মধ্যে যে জ্ঞানের বিস্তার ছিল গত পাঁচ বছরে সেটা আরও কমে গেছে।

সিনেমা বলতে গেলে বর্তমানের তরুণরা চাকচিক্যময় প্রেম-ভালোবাসার কাহিনী মনে করে। কিন্তু সিনেমা যে তার মধ্যে চিন্তার তৈরি করতে পারে, তাকে ধাক্কা দিয়ে চিন্তা করতে বাধ্য করতে পারে এই বোধ তাদের মধ্যে নেই। কারণ তারা সেই ধরনের চলচ্চিত্র দেখতে পাচ্ছে না। সবমিলিয়ে সামাজিক দিকগুলো তাকিয়ে বলতে পারি নতুন টেলিভিশন চ্যানেলগুলো যদি গতানুগতিক ধারার অনুষ্ঠানই প্রচার করে তাহলে নতুন চ্যনেল দিয়ে কোন লাভ হবে না। তাই নতুন চ্যানেল বা পত্রিকা না বাড়িয়ে বর্তমানে যেসব পত্রিকা এবং টেলিভিশন কাজ করছে তাদের অনুষ্ঠানের গুণগত মান বৃদ্ধি করা বেশি প্রয়োজন”।