জামিন পেয়ে হিমালয়ে যাবার কথা ছিলো মুশতাক-কিশোরের..


জামিন পেয়ে হিমালয়ে যাবার কথা ছিলো মুশতাক-কিশোরের..

ছবি- প্রথম আলো

 

জামিন পেয়ে দুজন মিলে হিমালয়ের বেসক্যাম্পে বেড়াতে যাবেন। এমন পরিকল্পনা ছিল কারাগারে মৃত্যুবরণ করা লেখক মুশতাক আহমেদ এবং কার্টুনিস্ট কিশোরের। প্রথম আলোকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এমনটাই বলেছেন কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর। 

গ্রেফতারের ঘটনা 

ফেসবুকে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে ১১ জনকে আসামী করে র‍্যাবের দায়ের করা একটি মামলায় গ্রেফতার করা হয় কিশোরকে। তার বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো ছাড়াও জাতির জনকের প্রতিকৃতি, জাতীয় সংগীত এবং জাতীয় পতাকাকে অবমাননার অভিযোগ আনা হয়েছিলো। অভিযোগের প্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ৫ই মে কাকরাইলের নিজ বাসা থেকে আহমেদ কবির কিশোরকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে র‍্যাপিড একশন ব্যাটালিয়ন। 

মামলার এজহারে র‍্যাব উল্লেখ করে “আই এম বাংলাদেশি পেইজটির এডমিন সায়ের জুলকারনাইন এবং আমি কিশোর, আশিক ইমরান, ফিলিপ শুমাখার, স্বপন ওয়াহিদ, মুশতাক আহমেদ। এই ৫ টি ফেইসবুক আইডিসহ পাঁচজন এডিটর পরস্পর যোগসাজশে উক্ত ফেসবুক পেজটি পরিচালনা করে আসছে”। 

‘আই এম বাংলাদেশী’ ফেসবুক পেইজ থেকে বিভিন্ন মিথ্যা তথ্য এবং গুজব ছড়ানো হচ্ছে যা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুন্ন করার পাশাপাশি জনগনের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে ও আইন শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে বলে এজহারে দাবী করে র‍্যাব। 

পেইজটিতে রাষ্ট্রবিরোধী পোস্ট, মহামারি করোনা ভাইরাস, সরকার দলীয় বিভিন্ন নেতার কার্টুন দিয়ে গুজব ছড়িয়ে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টির প্রমাণ মিলেছে বলেও দাবী করে র‍্যাব। 

প্রায় ১০ মাস পর জামিন 

৫ই মে র‍্যাবের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর প্রায় ১০ মাস পর সম্প্রতি ২০২১ সালের ৩ মার্চ জামিন পান কিশোর। জামিন আদেশের পরদিন বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কাশিমপুর কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি। সেখান থেকে সরাসরি ঢাকায় তার আইনজীবীর সাথে দেখা করতে যান তিনি। তখন গাড়ি থেকে নেমে তাকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে দেখা যায়। তার কান থেকে তখন পুঁজ পড়ছিল। 

সেখানে প্রথম আলোর সাংবাদিকের সঙ্গে দেখা হয় তার। সাংবাদিকের ভাষ্যমতে, সদ্য কারাগারে মৃত্যুবরণ করা লেখক মুশতাকের প্রসংগ তুলতেই ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেন কিশোর। কিশোর জানান, ২৩ ফেব্রুয়ারি শেষবারের মতো দেখা হয়েছিল লেখক মুশতাকের সাথে। তারপর মুশতাকের মৃত্যুর ১২ ঘন্টা পর পত্রিকায় মৃত্যুর খবর জানতে পারেন। একসাথে হিমালয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও আর যাওয়া হবে না কখনো। 

গ্রেফতারের পূর্বে ৬৯ ঘন্টা 

জামিনে মুক্তি পেয়ে আইনজীবীর সাথে দেখা করতে গেলে সেখানে প্রথম আলোকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আহমেদ কবির কিশোর জানান, ২০২০ সালের মে মাসের ২ তারিখ বিকাল সাড়ে ৫ টায় তাকে নিজ বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রায় ৬৯ ঘন্টা প্রশ্ন এবং মারধরের পর তিনি নিজেকে আবিষ্কার করেন র‍্যাবের হেফাজতে। 

সেই ৬৯ ঘন্টার বিবরণে তিনি বলেন, ১৬-১৭ জন মিলে কোন ধরনের গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়া তার ঘরে ঢুকে তল্লাশি শুরু করে। অন্তত চার জনের হাতে অস্ত্র ছিল তখন। সমস্ত ঘর ওলট-পালট করে তারা কিশোরের মুঠোফোন, সিপিইউ, পোর্টেবল হার্ডডিস্কসহ যত ডিজিটাল ডিভাইস ছিল সব কিছু নিয়ে নেন এবং কিশোরকে হাতকড়া পরিয়ে নিচে নামান। কিশোরের চিৎকার চেচামেচিতে মানুষ জড়ো হলে বিশেষ এক ধরনের টুপি (যা নাক পর্যন্ত ঢাকা) পরিয়ে তাকে গাড়িতে তোলা হয়। সেসময় নিচে ৬-৭টি গাড়ি ছিল বলে জানান তিনি। গাড়িতে তুলে উচ্চ শব্দে গান ছেড়ে দিলে কিশোরের চিৎকার আর বাইরের কেউ শুনতে পায়নি। 

সেখান থেকে তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয় তা বলতে পারেনি কিশোর। তার ভাষ্যমতে, অমসৃণ মেঝে এবং স্যাঁতসেঁতে একটি ঘরে তাকে রাখা হয়। সেখানে একটি এগজস্ট ফ্যান এবং তিনটি চেয়ার ছিল। পরে রাতে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় অন্য একটি রুমে। অন্য রুমে নেয়ার আগ পর্যন্ত তিনি মেঝেতে শুয়ে ছিলেন। 

অন্য রুমে বেশ কয়েকজন লোক প্রজেক্টরে কিশোরকে তার আঁকা কার্টুনগুলো দেখান এবং কার্টুনগুলোর মর্মার্থ জানতে চান। পেছনে ফিরে তাকালে তাকে জানে মেরে ফেলা হবে এমন হুমকিও দেয়া হয় অজ্ঞাতনামা লোকগুলোর পক্ষ থেকে। করোনাকালে তার আঁকা কার্টুনগুলো তিনি কেন এঁকেছেন, এসব কার্টুনের চরিত্র কারা, ইত্যাদি প্রশ্ন করা হয়। প্রশ্ন করার এক পর্যায়ে প্রচন্ড জোরে তার কানে থাপ্পর দেয়া হলে তার কান দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এরপর স্টিলের পাত বসানো লাঠি দিয়ে পায়ে পেটাতে থাকে বলে জানান তিনি। 

কার কার সঙ্গে তার যোগাযোগ, কেন যোগাযোগ, সুইডেনপ্রবাসী সাংবাদিক তাসনীম খলিলের সঙ্গে তাঁর কীভাবে যোগাযোগ, ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীনকে কী করে চেনেন, ব্লগারদের ওপর আবার হামলা হতে পারে এই আশঙ্কার কথা কেন আসিফ মহিউদ্দীনকে বলেছেন, বেসরকারি একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যানকে কীভাবে চেনেন, কেন ওই ব্যক্তির কার্টুন এঁকেছেন এরকম কয়েক দফা প্রশ্ন করা হয় কিশোরকে। প্রশ্নের উত্তর দেয়া প্রসঙ্গে কিশোর বলেন যে তিনি যে উত্তরই দিচ্ছিলেন কোন উত্তরই তাদের মনঃপুত হচ্ছিল না। 

কয়েকদফা প্রশ্নের পর তাকে রেখে আসা হয় র‍্যাবের কার্যালয়ে। সেখানে লেখক মুশতাকের সাথে দেখা হয় তার। পরদিন সকালে অর্থাৎ ৬ই মে ২০২০ তারিখে তাদের রমনা থানায় পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়। 

র‍্যাবের বক্তব্য 

র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ কিশোরের এই বক্তব্যের সাথে সম্পূর্ণ ভিন্নমত প্রকাশ করে প্রথম আলোকে বলেন, “অভিযোগ একেবারেই ভিত্তিহীন। একজন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি আত্মপক্ষ সমর্থনে যেকোনো বক্তব্য দিতে পারেন। একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে কার্টুনিস্ট কিশোরকে আদালতে সোপর্দ করা হয়। গত বছরের মে মাসে গ্রেপ্তারের পর দীর্ঘদিন অতিবাহিত হয়েছে। এত পরে এমন অভিযোগ উঠলে প্রশ্ন ওঠার অবকাশ থাকে”। 

মারধরের প্রশ্নে তিনি বলেন, “পুলিশে হস্তান্তরের আগে যেকোনো অপরাধীকে ডাক্তারি পরীক্ষা করা হয়। র‍্যাব সম্পূর্ণ বিধিবিধান মেনে আসামি হস্তান্তর করেছে। এত দিন পর কেন বলছেন? সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি যেকোনো কিছুই বলতে পারেন”। 

এদিকে কারাগারে সুচিকিৎসা পাননি বলেই অভিযোগ করেছেন কিশোর। মুক্তি পেলে ভালো চিকিৎসক দেখানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন জেল সুপার। জামিনের আগে কারাগারে কিশোরকে দেখতে এসে জেল সুপার এই পরামর্শ দিয়েছিলেন বলে জানান কিশোর। 

কিশোরের পরিচয় কী? 

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এক বিবৃতি থেকে জানা যায় কিশোর একজন আন্তর্জাতিক পুরষ্কার বিজয়ী কার্টুনিস্ট। তিনি বিভিন্ন সময় বেশ কয়েকটি জাতীয় দৈনিকের রম্য সাময়িকীতে কার্টুন এঁকেছেন। অংশ নিয়েছেন স্বৈরাচার ও জামায়াত-শিবির-রাজাকারবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে কার্টুন প্রদর্শনীতেও। 

শিক্ষাজীবনে খুলনা বিএল কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। তারপর ভর্তি হন বুয়েটে। কিন্তু সেখানে মন টেকেনি বেশিদিন। বুয়েটের পড়াশুনার পাট না চুকিয়েই যোগ দিয়েছিলেন নৌবাহিনীর অফিসার ক্যাডেট হিসেবে। তবে থিতু হতে পারেননি সেখানেও। শেষ পর্যন্ত থিতু হন কার্টুনের জগতে। 

ক্ষমতাসীন দলের দুর্নীতির অভিযোগের সমালোচনা নিয়ে তার করা কার্টুন ‘লাইফ ইন দ্য টাইম অব করোনা’ তার উল্লেখযোগ্য কার্টুন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এটি তার ফেসবুক পেইজ ‘আই অ্যাম বাংলাদেশি’তে প্রকাশিত হয়। তার বেশ কিছুদিন পরেই র‌্যাবের হাতে আটক হন তিনি। 

বাংলাদেশের একমাত্র কার্টুন ম্যাগাজিন 'উন্মাদ' ২০০৫ সাল থেকে কার্টুনিস্টদের জন্য পদক প্রবর্তন করে। পদক প্রবর্তনের প্রথম বছরেই এই 'উন্মাদ' পদক পেয়েছিলেন কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর। কার্টুন আঁকার পাশাপাশি লেখালেখিও করেন তিনি। তার এখনও পর্যন্ত চারটি বই প্রকাশিত হয়েছে।