প্রতিহিংসা আর শিক্ষক রাজনীতির শিকার সামিয়া রহমান?


প্রতিহিংসা আর শিক্ষক রাজনীতির শিকার সামিয়া রহমান?

'প্রতিহিংসা আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতির নোংরামির চরম শিকার আমি' বললেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সামিয়া রহমান।

সোমবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি।

শিকাগো জার্নাল থেকে তার বিরুদ্ধে পাঠানো চৌর্যবৃত্তির অভিযোগকে মিথ্যা এবং বানোয়াট উল্লেখ করে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে ১৩টি প্রশ্ন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ও রাষ্ট্রপতির কাছে এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের আবেদন জানান এবং একই সাথে আদালতে যাবারও ঘোষনা দেন তিনি।

সংবাদ সম্মেলনে শিকাগো জার্নাল থেকে পাঠানো মেইলকে বানানো এবং ষড়যন্ত্রমূলক বলে দাবি করে তিনি বলেন, এ সংক্রান্ত কোন চিঠি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে পাঠানো হয়নি। অ্যালেক্স মার্টিন বলে শিকাগো জার্নালে কেউ কখনো কাজ করেনি। এমনকি শিকাগো ইউনিভার্সিটি এবং শিকাগো প্রেসেও অ্যালেক্স মার্টিন বলে কেউ নেই। শিকাগো জার্নালের এডিটর ক্রেইগ ওয়াকার নিজে স্বীকার করেছেন যে, 'অ্যালেক্স মার্টিন নামের কেই কখনো শিকাগো জার্নালে কাজ করেনি’। দাবির পক্ষে একটি স্ক্রিণশটও সাংবাদিকদের উপস্থাপন করেন তিনি।

২০১৬ সালের ডিসেম্বরে সামিয়া রহমান ও সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজানের যৌথভাবে লেখা ‘এ নিউ ডাইমেনশন অব কলোনিয়ালিজম অ্যান্ড পপ কালচার: এ কেস স্ট্যাডি অব দ্য কালচারাল ইমপেরিয়ালিজম’ শিরোনামে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সোশ্যাল সায়েন্স রিভিউ’ জার্নালে আট পৃষ্ঠার একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। পরে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শিকাগো জার্নালে প্রকাশিত মিশেল ফুকোর ‘দ্যা সাবজেক্ট এন্ড পাওয়ার’ প্রবন্ধ থেকে চৌর্যবৃত্তি করার অভিযোগ উঠে।

চৌর্যবৃত্তির অভিযোগে অভিযুক্ত নিবন্ধটি তার নামে প্রকাশ করে তার সহকর্মী সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'নিবন্ধটি প্রকাশনার জন্য আমি জমা দিইনি, রিভিউয়ারের রিপোর্ট সম্পাদনা পরিষদ থেকে আমার কাছে কখনই পাঠানো হয়নি এবং কোন অ্যাকসেপ্টেন্স লেটারও আমার বরাবরে প্রেরণ করা হয়নি। আমাকে না জানিয়ে লেখাটি কেন মারজান জমা দিয়েছিল এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে সে আমার সাথে উদ্ধত আচরণ করে'।

লেখাটির সাথে তার কোন সম্পৃক্ততা নেই, শুধুমাত্র আইডিয়াটি তার উল্লেখ করে তিনি বলেন, "বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোনো জার্নালে নিবন্ধ জমা দেবার সময় লেখকের স্বাক্ষর প্রয়োজন হয়। ডীন অফিসে লেখকরা লেখা জমা দেবার পর, সেটি সম্পাদনা পরিষদ যাচাই বাছাই করেন, তারপর সেটি রিভিউয়ারের কাছে যায়, রিভিউয়ার সেটি বাতিল বা গ্রহণ করলে সেটি আবার সম্পাদনা পরিষদ বরাবর লেখকের কাছে যায়। লেখকের সংশোধনের পর সেটি আবার সম্পাদনা পরিষদ যাচাই বাছাই করে ছাপার যোগ্য মনে করলে লেখাটি প্রকাশ করেন। এই লেখাটি প্রকাশনার জন্য এডিটোরিয়াল বোর্ডে দাখিল থেকে প্রকাশিত পর্যন্ত কোনো ধাপেই আমার জড়িত থাকার কোন দালিলিক প্রমাণ তদন্ত কমিটিও দেখাতে পারনি এবং ট্রাইবুনাল তাদের রায়ে ব্যাপারটি স্পষ্ট করে জানিয়েছে''।

পরবর্তীতে তিনি তৎকালিন সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের ডীন ড. ফরিদউদ্দিনের সামনে লেখাটি প্রথমবারের মতো লেখাটি দেখেন এবং তখনই লেখাটি অত্যন্ত দুর্বল মনে হওয়ায় তিনি লেখাটি প্রত্যাহারের জন্য শিকাগো জার্নালের মিথ্যা মেইল আসারও সাত মাস পূর্বে ২০১৭ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি দরখাস্ত জমা দেন বলে দাবি করেন তিনি। “তৎকালিন সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের ডীন ড. ফরিদউদ্দিন নিজে স্বাক্ষর দিয়ে তা গ্রহণ করলেও, সেসময় তা তিনি সিন্ডিকেটের কারনে উত্থাপন করেননি বরং ভিসি বদলের ২ দিনের মাথায় সিন্ডিকেটে উত্থাপন করবেন বলে আমাকে কল দিয়ে জানান। যেটি উদ্দেশ্যপ্রণোদীতভাবেই করা হয়েছে” বলে মন্তব্য করেন তিনি। একই সাথে তার দরখাস্ত গ্রহণের প্রমাণ হিসেবে তৎকালিন সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের ডীন ড. ফরিদউদ্দিনের স্বাক্ষরকৃত কপি তিনি সংবাদকর্মীদের সামনে উপস্থাপন করেন।

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো প্রেস থেকে চৌর্যবৃত্তির লিখিত অভিযোগ পাঠানো হলে সে বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক নাসরিন আহমেদকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে সিন্ডিকেট। ২০১৯ সালে তদন্ত কমিটি চৌর্যবৃত্তির প্রমাণ পাওয়া গেছে উল্লেখ করে তাদের তদন্ত ফলাফল জমা দেয়।

চৌর্যবৃত্তির অভিযোগের ভিত্তিতে যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল সেই তদন্তের কার্যকারিতা ষড়যন্ত্রমূলক উল্লেখ করে সামিয়া রহমান বলেন, “গত ৪ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসাশনের চাপে ও তদন্তাধীন বিষয় বলে মুখ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছিলাম। তার সুযোগে ষড়যন্ত্রকারীরা দিনের পর দিন প্রোপাগান্ডা চালিয়েছে আমার বিরুদ্ধে। যে লেখাটি আমি লিখিনি, জমাই দিইনি, ডীন অফিসে আমার কাছ থেকে লেখার কোন হার্ড বা সফট কপি জমা দেবার কোন প্রমাণ তদন্ত কমিটি, ট্রাইবুনাল পর্যন্ত পায়নি, রিভিউয়ারের কোন কপিও আমার কাছে আসেনি”।

সামিয়া রহমান ও সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজানের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় শাস্তির সুপারিশের জন্য ২০২০ সালের ২৯ অক্টোবর আইন অনুষদের ভারপ্রাপ্ত ডিন ও সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক মো. রহমত উল্লাহকে আহ্বায়ক করে একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ট্রাইব্যুনাল দুজনের একটি করে ইনক্রিমেন্ট বাতিলের শাস্তি প্রস্তাব করেছিল কিন্তু সার্বিক দিক বিবেচনা করে সিন্ডিকেট সেই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে গত ২৮ জানুয়ারি দুজনকে পদাবনতি করে। এতো সহযোগী অধ্যাপক থেকে সহকারী অধ্যাপকে পদাবনতি হয় সামিয়া রহমানের।

ট্রাইবুনালের রায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে সিন্ডিকেট তার প্রতি অবিচার করেছে দাবি করে তিনি বলেন যে ট্রাইবুনালের আহবায়ক ড. রহমত উল্লাহ, সদস্য জিনাত হুদা নিজে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন যে ন্যায় বিচার হয়নি। ট্রাইবুনাল তার বিরুদ্ধে নয় উলটো এডিটরের, রিভিউয়ারের শাস্তির সুপারিশ করেছিল।

শাস্তিপ্রদান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চৌর্যবৃত্তির কোন আইনই নেই, তাহলে কোন নিয়ম-নীতির ওপর ভিত্তি করে তারা তাকে এই শাস্তি প্রদান করলো? লিখিত বক্তব্য পাঠদানের শেষে এক সাংবাদিকেরা প্রশ্নের উত্তরে তিনি প্রবন্ধটি লিখননি বলে সরাসরি দাবি করেন এবং নামোল্লেখ না করে প্রশাসনের কেউ কেউ ও কয়েকজন শিক্ষকের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন বলে উল্লেখ করেন। একই সাথে সাংবাদিকদের সেই ষড়যন্ত্রকারীদের খুঁজে বের করার আহবান জানান।
  
সংবাদ সম্মেলনে সামিয়া রহমানের সাথে আরও উপস্থিত ছিলেন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ, আইনজীবী তুরিন আফরোজ, সামিয়ার স্বামী সৈয়দ ফিরোজ আহমেদ ও তার বন্ধু মিলু এইচ রহমান।