ভ্যালেন্টাইন্স ডে উপাখ্যান


ভ্যালেন্টাইন্স ডে উপাখ্যান

শক্তিমান অভিনেতা প্রয়াত হূমায়ুন ফরিদী তার একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “এই পৃথিবীতে সম্ভবত সবচেয়ে বেশী উচ্চারন হওয়া শব্দ ভালোবাসা অথবা আমি তোমাকে ভালোবাসি”। ব্যাখ্যা হিসাবে বলেছিলেন, “সব ভাষাতেই ভালবাসা একই রকম, ভালোবাসার অনুভূতিই একই রকম”। সেই ভালোবাসার অনুভূতি নিয়েই ব্যাক্তিভেদে অবশ্য ভিন্ন হয়।

আজ ১৪ই ফেব্রুয়ারী, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। এই তথ্যটি সবার জানা থাকলেও- ভালোবাসা দিবস কিভাবে এলো? কিভাবেই বা ভালোবাসা দিবসের উৎপত্তি? এমন প্রশ্ন রেখেই পাঠকদের জন্য লিখছি ভালোবাসা দিবসের ইতিহাস।

সেন্ট ভ্যালেন্টাইন'স ডে বা ভালোবাসা দিবস প্রতি বছর ১৪ই ফেব্রুয়ারি পালিত হয়।

কে ছিলেন এই সেন্ট ভ্যালেন্টাইন?

একজন বিখ্যাত সেইন্ট বা ধর্ম যাজকের নাম থেকে এই দিনটি নামকরন করা হয়েছিলো। তবে তিনি কে ছিলেন? এ নিয়ে আছে বিভিন্ন গল্প- সবচেয়ে জনপ্রিয় বিশ্বাস হলো, সেন্ট ভ্যালেন্টাইন ছিলেন, খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে রোমের একজন পুরোহিত। সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস বিবাহ নিষিদ্ধ করেছিলেন। কারণ তার মনে হয়েছিল, বিবাহিত পুরুষরা খারাপ সৈন্য হয়ে যায়। কিন্তু ভ্যালেন্টাইন মনে করেছিলেন, ইহা অন্যায়। তাই তিনি নিয়ম ভেঙ্গে গোপনে বিয়ের ব্যবস্থা করেন। সম্রাট ক্লডিয়াস যখন এই খবর জানতে পারেন, তখনই ভ্যালেন্টাইনকে কারাগারে নিক্ষেপ করাএ আদেশ দেন। কারাগারে থাকা অবস্থায় ভ্যালেন্টাইন কারা প্রধানের মেয়ের প্রেমে পড়েন। ১৪ই ফেব্রুয়ারি যখন তাকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়, তখন ভ্যালেন্টাইন ওই মেয়েটির উদ্দেশ্যে একটি প্রেমপত্র পাঠিয়ে যান। যেখানে লেখা ছিল, "তোমার ভ্যালেন্টাইনের পক্ষ থেকে"। পরবর্তীতে সম্রাট ক্লডিয়াসের আদেশেই ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

এছাড়া উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুসারে, ২৬৯ সালে ইতালির রোম নগরীতে সেন্ট ভ্যালেন্টাইন'স নামে একজন খৃষ্টান পাদ্রী ও চিকিৎসক ছিলেন। ধর্ম প্রচারের অভিযোগে তৎকালীন রোম সম্রাট দ্বিতীয় ক্রাডিয়াস তাকে বন্দী করেন। কারণ তখন রোমান সাম্রাজ্যে খৃষ্টান ধর্ম প্রচার নিষিদ্ধ ছিল। বন্দী অবস্থায় তিনি জনৈক কারারক্ষীর দৃষ্টিহীন মেয়েকে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলেন। এতে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। আর তাই তার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে রাজা তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। সেই দিন ১৪ই ফেব্রুয়ারি ছিল। অতঃপর ৪৯৬ সালে পোপ সেন্ট জেলাসিউও ১ম জুলিয়াস ভ্যালেন্টাইন'স স্মরণে ১৪ই ফেব্রুয়ারিকে ভ্যালেন্টাইন' দিবস ঘোষণা করেন।

ইংরেজিতে ১৪৭৭ সালে লেখা হয়েছিল ভালোবাসা দিবসের প্রাচীনতম বার্তা।

ভ্যালেন্টাইন'স ডে কীভাবে শুরু হয়েছিল?

প্রথম ভ্যালেন্টাইন'স ডে ছিল ৪৯৬ সালে। একটি নির্দিষ্ট দিনে ভ্যালেন্টাইন'স ডে পালনের বিষয়টি বেশ প্রাচীনকালের ঐতিহ্য এবং মনে করা হয় যা রোমান উৎসব থেকে উদ্ভূত। রোমানদের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে লুপারকালিয়া নামে একটি উৎসব ছিল - আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের বসন্ত মৌসুম শুরু হওয়ার সময়। উদযাপনের অংশ হিসাবে ছেলেরা একটি বাক্স থেকে মেয়েদের নাম লেখা চিরকুট তুলতেন। যে ছেলের হাতে যেই মেয়ের নাম উঠত, তারা দুজন ওই উৎসব চলাকালীন সময়ে বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড/প্রেমিক-প্রেমিকা থাকতেন বলে মনে করা হয়। অনেক সময় ওই জুটিই বিয়েও করে ফেলতেন। পরবর্তী সময়ে, গির্জা এই উৎসবটিকে খ্রিস্টান উৎসবে রূপ দিতে চেয়েছিলো। একইসাথে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে স্মরণ করে এই উৎসব উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ধীরে ধীরে বিশ্বে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের নামটি মানুষের কাছে পরিচিত হতে শুরু করে। আর মানুষ তার ভালবাসার মানুষের কাছে নিজের অনুভূতি প্রকাশের জন্য এই নামটি ব্যবহার করা শুরু করে।

লাল কিউপিড দিয়ে ভালবাসা প্রকাশ করা হয়

তবে এটিও সর্বজন স্বীকৃত নয়। আছে, এখানেও দ্বিমত। কারও কারও মতে, প্রাচীন রোমে ভ্যালেন্টাইন নামে একজন চিকিৎসক ছিলেন। তিনি রোগীদের প্রতি ছিলেন ভীষণ সদয়। অসুস্থ মানুষের ওষুধ খেতে কষ্ট হতো বলে তিনি তেঁতো ওষুধে ওয়াইন, দুধ বা মধু মিশিয়ে খেতে দিতেন। সেই ডাক্তার খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। আর তখন প্রাচীন রোমে খ্রিস্টধর্ম মোটেও জনপ্রিয় ছিল না। এই ধর্মে বিশ্বাসীদের শাস্তি দেওয়া হতো। একদিন রোমের এক কারা প্রধান তার অন্ধ মেয়েকে ভ্যালেন্টাইনের কাছে নিয়ে এসেছিলেন চিকিৎসার জন্য। ভ্যালেন্টাইন কথা দিয়েছিলেন তিনি তার সাধ্যমতো চিকিৎসা করবেন। মেয়েটির চিকিৎসা চলাকালীন সময়েই হঠাৎ একদিন রোমান সৈন্যরা এসে ভ্যালেন্টাইনকে বেঁধে নিয়ে যায়। ভ্যালেন্টাইন তখনই বুঝতে পেরেছিলেন, খ্রিস্টান হওয়ার অপরাধে তাকে মেরে ফেলা হবে। ২৬৯ খ্রিষ্টাব্দে বা কারও মতে ২৭০খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি রোম সম্রাট ক্লডিয়াসের আদেশে ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তবে মৃত্যুর আগে ভ্যালেন্টাইন অন্ধ মেয়েটিকে বিদায় জানিয়ে একটি চিরকুট লিখে রেখে গিয়েছিলেন। হত্যার পর কারা প্রধান চিরকুটটি মেয়েটিকে পৌঁছে দেয়। তাতে লেখা ছিল, ‘ইতি তোমার ভ্যালেন্টাইন’ (‘From your Valentine’)। মেয়েটি চিরকুটের ভেতরে বসন্তের হলুদ ত্রৌকস ফুলের আশ্চর্য সুন্দর রং দেখতে পেয়েছিল কারণ, ইতোমধ্যে ভ্যালেন্টাইনের চিকিৎসায় মেয়েটির দু’চোখে দৃষ্টি ফিরে এসেছিল। ভালবাসার এসব কীর্তির জন্য ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে পোপ জেলাসিয়ুস ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখকে ভ্যালেন্টাইন্স ডে হিসেবে ঘোষণা করেন। সেই থেকে এই দিনটিকে মানুষেরা ভ্যালেন্টাইন্স ডে হিসেবে পালন করে আসছে।

৪৯৬ খ্রিষ্টাব্দে ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র শুরু হলেও এটি বিশ্বব্যাপী প্রথম দিকে তেমনিভাবে প্রচার ও প্রসার লাভ করেনি। পাশ্চাত্যের ক্ষেত্রে জন্ম দিনের উৎসব,ধর্মোৎসব সবক্ষেত্রেই ভোগের বিষয়টি মুখ্য। তাই গির্জা অভ্যন্তরেও মদ্যপানে তারা বিরত থাকে না। ভ্যালেন্টাইন দিবসের কারণে খ্রিস্টীয় চেতনা বিনষ্ট হওয়ার অভিযোগে ১৭৭৬ সালে ফ্রান্স সরকার ভ্যালেন্টাইন্স উৎসব নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ইংল্যান্ডে ক্ষমতাসীন পিউরিটানরাও একসময় প্রশাসনিক ভাবে এ দিবস উৎযাপন নিষিদ্ধ করেছিলো। শুধু ফ্রান্স কিংবা ইংল্যান্ডে নয় অস্ট্রিয়া,হাঙ্গেরি ও জার্মানিতে বিভিন্ন সময়ে এ দিবসটি জনগণ ও সরকারিভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল।

ক্যালিফোর্নিয়ার ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে পরিচিত পেঙ্গুইনরা 

তবে বর্তমান সময়ে ভ্যালেন্টাইন্স দিবস উৎযাপন বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে পাশ্চাত্যে এ উৎসব উপলক্ষে এই দিনে প্রায় কয়েক কোটি ডলার ব্যয় করে। ভালবাসা দিবসের জন্য মানুষেরা কার্ড, ফুল, চকোলেট ও অন্যান্য উপহার সামগ্রী ক্রয় করে। বিভিন্ন হিসাব মতে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই ১৪ই ফেব্রুয়ারী প্রায় ৩ কোটি শুভেচ্ছা কার্ড আদান-প্রদান করা হয়।

হোক গল্প বা বিশ্বাস! ভালোবাসা টিকে রবে পৃথিবী ধংসের শেষ দিন পর্যন্ত। যুদ্ধ,হানাহানি ভুলে ভালোবাসা ছড়িয়ে যাক বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। মানুষ ভালবাসতে শিখুক, যে ভালোবাসায় থাকবে পবিত্রতা।

তথ্যঃ ইন্টারনেট