চলে গেলেন সাংবাদিক শাহীন রেজা নূর


চলে গেলেন সাংবাদিক শাহীন রেজা নূর

শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের সন্তান, প্রখ্যাত সাংবাদিক ও প্রজন্ম' ৭১ এর সাবেক সভাপতি শাহীন রেজা নূর আর নেই। তিনি বাংলাদেশ সময় ১৩ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে কানাডার ভ্যাংকুভারে এক হাসপাতালে মারা যান তিনি।

তাঁর বড় ভাই জাহিদ রেজা নূর তিনি অগ্ন্যাশয় এর ক্যান্সারে ভুগছিলেন।

শালিখা থানার শরশুনা গ্রামে। পিতা শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন এদেশের সাংবাদিকতা জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি দৈনিক ইত্তেফাকের সাবেক সাবেক বার্তা ও কার্যনির্বাহী সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনীর সদস্য ও তাদের এ দেশীয় দোসর আলবদর ও আল শাম্সদের সহযোগিতায় যে বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ শুরু হয়, তার নির্মম শিকার হন সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন। শাহীন রেজা নূরের মা বেগম নূরজাহান সিরাজী ছিলেন একজন গৃহিনী। পিতা-মাতার ৮ সন্তানের মধ্যে শাহীন রেজা নূর ছিলেন দ্বিতীয়। 
১৯৮২ সালে বংগবন্ধুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সাবেক সংসদ সদস্য শামসুদ্দীন মোল্লার মেয়ে খুরশীদ জাহানের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি দুই পুত্র সন্তানের জনক। স্ত্রী একজন গৃহিনী। বড় ছেলে সৌরভ রেজা নূর ও ছোট ছেলে আবির রেজা নূর।


শিক্ষাজীবন:

শিক্ষা জীবনের শুরু হয় ঢাকার লক্ষীবাজারে একরামপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এখানে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত লেখা-পড়া করার পর ঢাকার কিশোরী লাল জুবিলি উচ্চ বিদ্যালয়ে ৪র্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন। সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত এখানে লেখা-পড়া করার পর ১৯৭০ সালে সিদ্বেশ্বরী উচ্চ বিদ্যালয় হতে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন ১৯৭৩ সালে জগন্নাথ কলেজ হতে। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি হন এবং ১৯৭৬ সালে গ্রাজুয়েশন করে বের হন। ১৯৭৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজীতে ভর্তি হন। ১৯৭৫ সালে তিনি অল্প কিছু দিনের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নে লেখা-পড়া করতে যান। কর্ম জীবনের মাঝে ২০০১ সালে তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্যে মাস্টার ডিগ্রী লাভ করেন।


পেশাগত জীবন:
পিতা শহীদ হওয়ার পর শাহীন রেজা নূর ১৯৭২ সালে ঢাকা বেতার কেন্দ্রে বার্তা বিভাগে অনুলিপিকারের চাকরী গ্রহণের মধ্যদিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন এবং অল্প দিনের মধ্যে অনুবাদকের ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭৩ সালের নভেম্বর মাসে দৈনিক ইত্তেফাকের শিক্ষানবিশ সহ-সম্পাদক পদে যোগ দেন। ১৯৮১ সালে সাংবাদিকতার উপর কমনওয়েলথের উদ্যোগে আয়োজিত সাংবাদিকতা বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে মালয়েশিয়াতে যান। প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে আবার ইত্তেফাকে কাজ শুরু করেন। সেই থেকে একটানা ১৬ বছর ইত্তেফাকে সাংবাদিকতা করার পর ১৯৮৮ সালে তিনি কানাডা যান। সেখানে মন্ট্রিয়াল থেকে বাংলা সাপ্তাহিক প্রবাস বাংলা প্রকাশের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। তাছাড়া ইমিগ্রেশন লইয়ারদের সঙ্গেও অনুবাদকের কাজ করেন। কানাডা থেকে দেশে ফিরে আবার দৈনিক ইত্তেফাকে যোগ দেন। দৈনিক ইত্তেফাকে তিনি নির্বাহী সম্পাদক থাকা অবস্থায় চাকরি ছেড়ে দেন। 
সাংবাদিক জীবনে তিনি ইরাক যুদ্ধ, আফগান যুদ্ধ, ইন্দিরা গান্ধির ক্ষমতাচ্যুতি, জুলফিকার আলী ভূট্টোর ফাঁসিসহ বহু আন্তর্জাতিক বিষয়ে প্রতিবেদন রচনা করে পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এবং প্রচুর প্রশংসা কুড়িয়েছেন। জাতীয় রাজনীতি, সামাজিক,  সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া বিষয়ের উপরও পত্রিকাতে প্রচুর লেখা-লেখি করেছেন। অনুবাদকের কাজও করেছেন অনেক। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পারভেজ মেশাররফ-এর লেখা বইটির অনুবাদ ও বিল ক্লিন্টনের আত্নজীবনী, যেগুলো ইত্তেফাকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। 


সামাজিক কর্মকান্ড :
শাহীন রেজা নূর প্রজন্ম’৭১–এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর নেতৃত্বে সংগঠনের কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি জোরদার করা ও মুক্তিযুদ্ধের  অঙ্গীকার বাস্তবায়নের বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণসহ আরও বেশকিছু বিষয়। শিক্ষার প্রসার ঘটানের জন্য শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চ নামে একটি সংগঠনের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। এছাড়াও সাবেক ছাত্রলীগ ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সমিতি, মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ, সেক্টর কমান্ডারস ফোরামসহ আরও অনেক সংগঠনের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে সমকালীণ  বিষয়ের উপর ‘সময়ের সংলাপ’ নামক একটি টকশো অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ছিলেন। 
তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের আওতায় ১৯৭১ সালের নৃশংস বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের বিচার কাজে একজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী। খালেদা জিয়ার আহবানে আন্দোলনের নামে যখন দেশব্যাপী পেট্রোল বোমা হামলার নারকীয় তান্ডব শুরু হয়েছিল - তখন শাহীন রেজা নূর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে "সত্যের অন্বেষণে" - এই ব্যানারে দেশব্যাপী জনমত গড়ে তোলায় অত্যন্ত দৃঢ় ভূমিকা রেখেছেন। ২০১৩ সালে গণ জাগরণ মঞ্চ আন্দোলনের সময়ে তিনি তরুণ নেতৃত্বের একজন আস্থাভাজন পরামর্শকই শুধু ছিলেন না - সক্রিয়ভাবে মাঠেও ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ ও দেশের বাইরেও গণ মাধ্যমের বিভিন্ন আয়োজনে অবিরতভাবে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে ও সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। কানাডায় অসুস্থ অবস্থায় প্রবাস যাপনের সময়ও তিনি একের পর এক লেখা লিখেছেন যা প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে নিয়মিত ছাপা হয়েছে। বংগবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তিনি অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন। এই দেশে নানা প্রতিকুলতার বিরুদ্ধে বংগবন্ধুর আদর্শ, এবং শেখ হাসিনার রাজনীতি প্রতিষ্ঠায় শাহীন রেজা নূর বরাবর সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। সকল অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চারকন্ঠ ছিলেন।
শাহীন রেজা নূর এর শেষ ইচ্ছা ছিল, তিনি দেশের মাটিতে শায়িত হবেন। এ ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী  ও কানাডার দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে।

সাংবাদিক শাহীন রেজা নূরের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

শনিবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) তার সহকারী প্রেস সচিব আশরাফ সিদ্দিকী বিটুর পাঠানো প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে গণআন্দোলনে শাহীন রেজা নূরের ভূমিকা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন।

প্রধানমন্ত্রী মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

সাংবাদিক জাহিদ রেজা নূর জানান, তার ভাই শাহীন রেজা নূরের মরদেহ দেশে আনতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন তারা। মৃত্যুর আগে শাহীন রেজা নূর দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন।