আফজালের জন্য শোকগাথা


আফজালের জন্য শোকগাথা

ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার বিজেসির সিনিয়র গবেষণা সহযোগী, সাংবাদিক মোঃ আফজালুর রহমানের অকালে চলে যাওয়া মেনে নিতে পারছেন না সম্প্রচার সাংবাদিক কর্মীরা। এই হঠাৎ মৃত্যুতে, আফজালের  সহকর্মীরা তাদের থমকে যাওয়া হৃদয়ে নিজেদের শোকগাথা প্রকাশ করেছেন, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে। 

একাত্তর টেলিভিশনের হেড অব নিউজ শাকিল আহমেদ লিখছেন,

"জীবন প্রকৃতই নিষ্ঠুর! না হলে কয়েক হাজার সাংবাদিকের করোনা থেকে বাঁচাতে দিনরাত যে কাজ করল; তারই চলে যেতে হবে কেন! নিজেকে নিজেদের ক্ষমা করতে কষ্ট হচ্ছে ...অপরাধী মনে হচ্ছে! 

চ্যানেল নাইন নিউজ বন্ধ হবার পর সদা বিনয়ী আফজাল এসে বলল; ভাই- আমার যা হওয়ার তো হল; বাকি সাংবাদিকেরও যেন না হয় সেজন্যই আমি কাজ করতে চাই! সেই থেকে বিজেসির ফুলটাইমার আফজাল... হাসিমুখে আমাদের শত স্বপ্নের সারথী হয়ে একাই টেনে নেয়ার কঠিন পথে সোজা হয়ে দাঁড়াল! আমরা তার জীবিকা হলাম --কিন্তু জীবন বাঁচাতে পারলাম না! 

মাসের শুরুতেই হঠাৎ জ্বর; সঙ্গে সঙ্গে টেস্ট- রাতেই জানা গেলো পজেটিভ! এবং পরদিনই জ্বর বেড়ে যাওয়ার খবর পেলাম। এমন জর, রাত-বিরেতে শ্বাসকষ্ট -পুরো করোনায় আমরা বহু সামলেছি! কিন্তু আফজালের সংকট ভিন্ন; সে মেসে একা থাকে; তার দেখার কেউ নেই! এবং আমাদের স্বজন ডা তুষারের মনে হলো, ছেলেটা তীব্র আতঙ্কে ভুগছে!

মানস'দাকে ও এসএমএস করল-তার হাসপাতালেই ভর্তি হওয়া দরকার! করোনায় সারাক্ষণ পাশে থাকবে কে- এই ভাবনায় আমরাও রাজি হলাম হাসপাতালে পাঠাতে। তখনও আমরা কেউ জানতাম না, তরুণ সবল ছেলেটির থাইরয়েড সংকট আছে; যার প্রভাবেই সে তীব্র আতঙ্কে ভোগে ..হার্ট বিট বেড়ে যায়! আর সেই "আতংক"ই করোনার বড় ঘাতক... আফজালকে আইসিইউ পর্যন্ত নিয়ে গেল! ওখানে তার অক্সিজেন লেভেল উঠল ৯৬। কিন্তু নতুন বিপত্তি হলো অ্যান্টিবায়েটিক রেজিস্টেন্স! শেষ দিকে কোন অ্যান্টিবায়েটিক আর কাজ করছিলো না...

শেষ রাতে তার হ্যালুসিনেশন হচ্ছিলো...একা একা কাকে যেন আফজাল বলছিলো...আমাদের তো আর সংসার করা হলো না....তুমি কবে আসবা? 

আহা বেটা...ভাই আমার...ক্ষমা করো...আর এইসব হাহাকার কাঞ্চনজঙ্ঘাকেই না হয় বলো... যার ছবি আছে তোমার শেষ ওয়ালে"..

সিনিয়র সাংবাদিক রাশেদ আহমেদ লিখেছেন,


"ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার নিয়ে ওর কতো স্বপ্ন, কতো ছুটোছুটি! করোনায় সবার সুরক্ষা দিতে কোন কাজটি করেনি আফজাল! স্যানিটাইজার বানানো থেকে শুরু করে চাল, ডাল বিতরণ! চ্যানেল ৯ থেকে চাকরি হারানোর পর পুরো সময়টিই রেখেছিল বিজেসির জন্য। গবেষণা সহযোগী হিসেবে ওর কাজে কোন ত্রুটি দেখিনি। করোনা হওয়ার পর হাসপাতালে শুয়ে ভাবতো কতো কাজ পড়ে আছে বিজেসির, তাড়াতাড়ি সুস্থ হতে হবে। আর হলোনা ফেরা। আফজাল যাবার আগে সতর্ক বার্তা দিয়ে গেলো আমাদের"।

বিজেসি'র ট্রাস্টি মানস ঘোষ লিখেছেন,
"আফজালের লাশবাহী গাড়ি রংপুর ছাড়িয়ে আরও উত্তরে, দেশের শেষ সীমান্ত শহরের দিকে ছুটে চলছে। আর আমি ভাবছি এ বুঝি ঘোর, এখনই হয়তো শুনবো- আফজাল ডাকছে দাদা!...আমাদের মধ্যে কেউ তখন বলেছিলো, ‘ব্যাপার না, টেনশন নিয়েন না আফজাল। করোনা সবার হচ্ছে, দ্রুত সেরে উঠবেন। নিজের যত্ন নিয়েন।’ মেসে দেখার কেউ নেই, জ্বরও থামছিলোনা। নিজের যত্ন নিতে আফজাল তাই হাসপাতালে যেতে চাইলো। সেই যাওয়া.....।

প্রথমদিকে কথা হতো। ভয়ে কাঁপতো শিশুর মতো, বলতে পারতো না কিছুই ঠিকঠাক। তারপর তো আইসিউ হয়ে একেবারে ধরাছোঁয়ার বাইরে.....।  অথচ জ্বর আসার একদিন আগেও বিজেসি নিয়ে আফজালের সাথে বসে কাজ করেছি। জমে থাকা কত হিসাব। কোভিডের কারনে ঠিকঠাক গোছানো হচ্ছিলো না। আফজাল বললো, দাদা একদম চিন্তা করবেন না, সব করে নেবো। বিজেসির হাসপাতাল হবে শুনে সেকি শিশুর মতো উচ্ছাস তার। তারপর মাত্র ১৮ দিনের ব্যবধান। আফজাল নেই....। আফজালের আর কখনোই ফেরা হবে না।

আফজাল করোনায় বিজেসির সম্মুখসারির প্রথম যোদ্ধাদের একজন। মার্চের মাঝামাঝি, বাজারে দুষ্প্রাপ্য হ্যান্ড-স্যানিটাইজার, শাকিলের উৎসাহে নিজেই কোথা থেকে শিখে এসে মিকচার বানাতে বসে যায়। তারপর আক্রান্তদের খোঁজ নিয়ে বাড়িতে প্রয়োজনীয় সামগ্রী পাঠানো থেকে শুরু করে হাসপাতাল, অ্যাম্বুল্যান্স, করোনা টেস্ট- বিজেসির যা কিছু কর্মকান্ড- সবকিছুতেই আফজাল! কত প্রাণ রক্ষা পেলো বিজেসির উদ্যোগে! সেই বিজেসিকেই কি না শেষ বেলায় এসে পেতে হলো এতো বড় ধাক্কা? হারাতে হলো তার আদর্শ ছেলেটাকে"!!?

এটিএন বাংলার সাংবাদিক জ ই মামুন লিখেছেন,


"আহা রে! মাত্র একত্রিশেই করোনা নিয়ে গেলো রিপোর্টার আফজালকে! কি বলবো, কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছি না"!

সিনিয়র সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা আফজালকে নিয়ে লিখেছেন,
"করোনায় মারা যাওয়া সাংবাদিকদের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আফজাল কি ভাবছিলো সে নিজেই এক সময় ছবি হয়ে যাবে? নিষ্ঠুরতম আঘাত আমাদের জন্য"...

নিজের ফেসবুক ওয়ালে ফারজানা রূপা লিখেছেন,

"আফজাল হাতের আঙ্গুল গলে বেরিয়ে গেলো! শূন্য হাতটার দিকে তাকিয়ে আছি। ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছে কেনো হাসপাতালে গেলাম না! হাত লাগালাম না! 
সবকিছু আবার আগের মতো হলে বেশি বেশি খাওয়ার কথা ছিল আফজালের। আরেকটু সময়- মনোযোগের ইচ্ছা ছিল আমাদের। 
সরি আফজাল"।

একাত্তর টিভির সিনিয়র রিপোর্টার নাজনীন মুন্নি লিখেছেন, 

"আমাদের আফজাল আর কোথাও নাই। ৩১ বছর বয়সে তার পৃথিরীতে থাকার সময় ফুরালো। করোনা ভ্যাক্সিন যেদিন দেশে, সেদিনই করোনা নিয়ে গেলো তারে। সবাই তার জন্য দোয়া করবেন'..

একাত্তর টিভির সিনিয়র রিপোর্টার মিলটন আনোয়ার বলেছেন,
"ভাইরে আমাদের তো আরো অনেক কিছু করার ছিল.. এত কীসের তাড়া ছিলো তোর.. ওপাড়ে ভালো থাকিস"..

আফজালের মৃত্যু সংবাদ জানিয়ে আরটিভির নিউজ এডিটর আক্তার হোসেন লিখেন,

"করোনা কেড়ে নিলো প্রিয় আফজালকে। চ্যানেল নাইনের সাবেক রিপোর্টার ও বিজেসির গবেষণা সহযোগী সাংবাদিক আফজাল মোহাম্মাদ আর নেই। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। করোনায় আক্রান্ত হয়ে আজ বিকেল ৪টায় শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে তার মৃ্ত্যু হয়। 
হে আল্লাহ এই মানুষটির মৃত্যুতে তার প্রিয়জনদের শোক সইবার শক্তি দিন। মহান আল্লাহ তাকে জান্নাত দান করুন।

মাহফুজ মিশুর স্ট্যাটাস-
"আফজাল নাই... কীভাবে এটা বিশ্বাস করবো"!!