'গণমাধ্যমের সংকট অতিক্রমে প্রয়োজন সত্যনিষ্ঠা'


'গণমাধ্যমের সংকট অতিক্রমে প্রয়োজন সত্যনিষ্ঠা'

ছবি : সংগৃহীত

 

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক দিনগুলোতে গণতন্ত্র এবং গণমাধ্যম—উভয় ক্ষেত্রেই সংকট বেড়েছে। নানামুখী চাপ সৃষ্টি হয়েছে। তবে দেশের ও গণমাধ্যমের উভয় ক্ষেত্রেই ভবিষ্যতে অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। সত্যনিষ্ঠা নিয়ে বস্তুনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাওয়াই গণমাধ্যমের এই সংকট উত্তরণের পথ বলে মন্তব্য করেছেন শিক্ষাবিদ ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকেরা।

১৪ নভেম্বর, রোববার ‘গণমাধ্যম, গণতন্ত্র ও বাংলাদেশ’ শিরোনামে আলোচনায় এমন মন্তব্য করেন তারা।

জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী প্রদর্শনী কক্ষে প্রথম আলোর ২৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে গত শনিবার থেকে শুরু হয়েছে সপ্তাহব্যাপী বিশেষ প্রদর্শনী। ‘আলোয় আঁধারে’ নামের এই প্রদর্শনীতে শিল্পী ওয়াকিলুর রহমান প্রথম আলোর ২৩ বছরের পথপরিক্রমায় সংবাদপত্র থেকে দেশের একটি অন্যতম প্রধান গণমাধ্যমে রূপান্তরিত হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেন। প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত প্রদর্শনী সবার জন্য খোলা থাকছে। আর বাড়তি সংযোগ হিসেবে প্রতিদিন বিকেল পাঁচটায় থাকছে বিভিন্ন আয়োজন। এরই অংশ হিসেবে রোববার ছিল এই আলোচনা।

আলোচনার সূত্র ধরিয়ে দিয়ে সঞ্চালক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ বলেন, ‘অনেকেই সভ্যতার উত্তরাধিকার হিসেবে গণতন্ত্র, বাক্‌স্বাধীনতা, অসাম্প্রদায়িকতার মতো বিষয়গুলো পেয়ে থাকেন। কিন্তু আমাদের তা অর্জন করতে হয়েছে দীর্ঘ আন্দোলন এবং রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ভেতর দিয়ে। ফলে দেশে গণতন্ত্র, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার মতো বিষয়গুলো কোন পর্যায়ে রয়েছে, তা সামগ্রিকভাবে বুঝে নিতেই এই আলোচনার আয়োজন।’

শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বললেন, ‘সংবাদপত্র কখনো সরকারের শত্রু হতে পারে না। সংবাদপত্র সত্যি কথা বলবে। সেই সত্যানুসারে প্রতিকারের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে অন্যায়, দুর্নীতির দমন হবে। জনসাধারণ উপকৃত হবে। দেশের উন্নয়ন এবং গণতন্ত্রের ভিত শক্ত হবে। সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা বাড়বে, জনপ্রিয়তা বাড়বে। শেষ বিচারে সরকারই লাভবান হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। সত্যানুসন্ধানে সাংবাদিকদের বাধা দেওয়া হয়। নানা রকমের আইন করে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হয়’।

সম্প্রতি স্বাস্থ্য বিভাগের দুর্নীতির সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামের ওপর নির্যাতনের ঘটনার দৃষ্টান্ত দিয়ে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘সাংবাদিককে দমনপীড়ন না করে যদি স্বাস্থ্য বিভাগের দুর্নীতি–অনিয়ম দমনের উদ্যোগ নেয়া হতো, দুর্নীতির বিষয়গুলো প্রকাশে বাধা না দেয়া হতো, তাহলে মানুষ আরও বেশি স্বাস্থ্যসেবা পেতো। সরকারের উদ্যোগ প্রশংসিত হতো’।

‘গণমাধ্যম, গণতন্ত্র ও বাংলাদেশ’ বিষয়ে আলোচনায় বক্তব্য দিচ্ছেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। পাশে মনজুরুল আহসান বুলবুল ও মতিউর রহমান। ছবি : সংগৃহীত

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এ ক্ষেত্রে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও দায়িত্বশীলতা এবং শুদ্ধতার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্র এবং গণমাধ্যমের ওপর ক্ষমতাসীনদের এই চাপ শুধু বাংলাদেশেই নয়, প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমারেও রয়েছে। তবে সততা, শুদ্ধতাই হচ্ছে শক্তি। এই শক্তি নিয়েই গণমাধ্যমকে এগোতে হবে’।

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল আইনি সমস্যাগুলোর ওপরে আলোকপাত করে বলেন, ‘গণমাধ্যমের ওপর ভেতর এবং বাইরের দুই ধরণের চাপ রয়েছে। এখন গণমাধ্যম চলে গেছে বিভিন্ন করপোরেট হাউসের কাছে। তাদের নিজস্ব প্রত্যাশা, চাহিদা, পছন্দ–অপছন্দ থাকে। এটা একরকমের চাপ সৃষ্টি করে। আর বাইরে থেকে ক্ষমতাসীন বা বিরোধী পক্ষ এবং বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠী, ধর্মীয় প্রভাব—এসবের একটি চাপ আছে। এছাড়া গণমাধ্যমের আইন নিয়ে একটা বড় রকমের সমস্যা আছে’।

মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, ‘পুরোনো আইন সময়ের সঙ্গে সাযুজ্য তৈরি করতে পারছে না, অথচ যুগোপযোগী নতুন আইনও নেই। সম্প্রচারনীতি করা হচ্ছে কিন্তু আইন করা হচ্ছে না। এই নীতিতে অনেক আপত্তিকর বিষয় আছে। সাংবাদিকেরা এর প্রতিবাদ করেছেন। কিন্তু পরিস্থিতির বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। এসব কারণে সাংবাদিকেরা যা বলতে চান, যা করতে চান, সেই কাজটি ঠিকমতো করতে পারছেন না। অপর দিকে সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তাহীনতা এবং বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা এক রকম ভীতিকর প্রভাব সৃষ্টি করে’।

তিনি আরো বলেন, ‘স্বাধীনতার পর গত ৫০ বছরে নানা ঘটনায় দেশে ৪৮ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন। কিন্তু একটি ঘটনারও দৃষ্টান্তমূলক বিচার ও সাজা কার্যকরের দৃষ্টান্ত নেই। এই চ্যালেঞ্জগুলো নিয়েই সাংবাদিকতাকে এগিয়ে নিতে হবে। তিনিও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা, ভালো সাংবাদিকতার ওপর জোর দিয়ে বলেন, এর কোনো বিকল্প নেই’।

ভালো সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি বৈচিত্র্যময় নতুন বিষয়, উপস্থাপনার নতুন কৌশল, নতুন আঙ্গিকের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন মনজুরুল আহসান বুলবুল।

আলোচনায় আরও অংশ নেওয়ার কথা ছিল দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের। অসুস্থতার জন্য তিনি উপস্থিত থাকতে পারেননি। আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রেই এগিয়েছে। সামনে আরও অনেক সম্ভাবনা আছে। কিন্তু এটাও ঠিক, গত শতকের ষাটের দশকে “গণতন্ত্র চাই’’, “সংবাদপত্রের স্বাধীনতা চাই’’—এমন যে স্লোগানগুলো দেয়া হতো, এখনো সেই স্লোগান দেয়া হচ্ছে, দাবি তোলা হচ্ছে। তাহলে বিষয়টি কেমন হলো? সার্বিক মূল্যায়ন করতে গেলে এমন একটি গোলমেলে প্রশ্ন আমাদের সামনে চলে আসে।’

মতিউর রহমান বলেন, ‘আশার কথা হলো, জনগণ বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পছন্দ করেন। প্রথম আলো বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করতে সচেষ্ট। সে কারণেই পাঠকপ্রিয়তা লাভ করেছে। বিপুলভাবে সফল হয়েছে’।

শেষে ছিল গান। পুরো আলোচনার মূল সুরেই ছিল সংকট অতিক্রমে সত্যনিষ্ঠার চর্চা অব্যাহত রাখার কথা।