দোষারোপ নয় ক্লিনফিড বাস্তবায়নে দরকার সমন্বিত উদ্যোগ


দোষারোপ নয় ক্লিনফিড বাস্তবায়নে দরকার সমন্বিত উদ্যোগ

ছবি : সংগৃহীত

 

আবু রায়হান, বিজেসি নিউজ: ক্লিনফিড বাস্তবায়ন না হওয়ায় ১ অক্টোবর থেকে এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশে ভারতীয় চ্যানেলসহ বেশ কিছু চ্যানেল সম্প্রচার বন্ধ রয়েছে। এর আগে বিভিন্নবার ক্লিনফিড বাস্তবায়নের সময় বেঁধে দেয়া হলেও সেটি কার্যকর না হওয়ায় এবার কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার।

সরকারের এ অবস্থানকে স্বাগত জানিয়েছে সম্প্রচার সাংবাদিকদের সংগঠন ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার-বিজেসি। দীর্ঘদিন থেকে ক্লিনফিডের দাবি জানিয়ে আসছিলো সংগঠনটি। বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়েছে দেশের বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠন ও দেশের টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন অ্যাটকো। আর এই উদ্যোগে সন্তুষ্ট না হলেও এখন পর্যন্ত সরকারকে সহযোগিতা করে চলেছে ক্যাবল অপারেটররা। 

 

ক্লিনফিড কার্যকর না হওয়ার দায় কার?

অনেকে বলছেন বিদেশি চ্যানেলগুলোর সদিচ্ছার অভাবের ফলেই এমনটা হচ্ছে। তবে এজন্য ক্যাবল অপারেটরদেরকেও দোষারোপ করা হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে।

এ বিষয়ে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল সময় টিভির সম্প্রচার ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রধান সালাউদ্দিন সেলিম বিজেসি নিউজকে জানান, বিদেশি চ্যানেল বা বিশেষ করে ভারতীয় চ্যানেলগুলো বিভিন্ন দেশে ক্লিনফিড দিচ্ছে। সেটিই বাংলাদেশের ফ্রিকোয়েন্সিতে আপলোড দিয়ে দিলে এখানেও চলতে পারে।

 

ছবি : সংগৃহীত

সালাউদ্দিন সেলিম জানান, ভূটান, শ্রীলংকার চাইতে বাংলাদেশেই ভারতীয় চ্যানেলের বাজার বেশি বিস্তৃত। কারণ ব্যবসাটা আসলে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমেই হচ্ছে। তাই তারা ক্লিনফিড দিতে চাইছে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভারতীয় চ্যানেলের একজন পরিবেশক বিজেসি নিউজকে জানান, ক্লিনফিডে ব্রডকাস্টার বিজ্ঞাপনের জায়গাটা খালি রাখে বিজ্ঞাপন ঢোকানোর জন্যই। কারণ মূল ব্যবসা হয় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমেই। প্রত্যেকটা আলাদা মার্কেটের জন্য তারা আলাদা বিজ্ঞাপন নেয় এবং যখন সে ডাউনলিংক করে তখন সেখানে বিজ্ঞাপনটা দিয়ে দেয়। তারপর তা গ্রাহকের কাছে পৌঁছায়।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে ক্লিনফিড বাস্তবায়নের জন্য বড় ধরণের বিনিয়োগ প্রয়োজন এবং সেকারণে ক্যাবল অপারেটরের সংখ্যাও কমিয়ে আনতে হবে। সংখ্যাটা কম এবং নেটওয়ার্ক ডিজিটাল হলে বিদেশি চ্যানেলগুলো এই সহায়তা করতে পারবে’।

 

নেটওয়ার্ক কেন ডিজিটাল হচ্ছে না?

অনেকেই মনে করছেন সম্প্রচার পদ্ধতি ডিজিটাল না হওয়ার পেছনে ক্যাবল অপারেটররা দায়ী। এর পেছনে ক্যাবল অপারেটরদের কারিগরি দক্ষতার অভাব, পুঁজির স্বল্পতা এবং সদিচ্ছার অভাব রয়েছে।

ক্লিনফিড বাস্তবায়নের বিষয়ে ক্যাবল অপারেটরস সমন্বয় কমিটি-কোয়াবের যুগ্ম আহবায়ক সৈয়দ মোশারফ আলী বিজেসি নিউজকে বলেন, ‘ক্যাবল অপারেটরদের অনিচ্ছার কারণে ক্লিনফিড হচ্ছে না এটা সত্য নয়। আমরা আইন মেনে বিদেশি চ্যানেল বন্ধ করে দিয়েছি। ক্লিনফিড করাটা ব্রডকাস্টারদের কাজ। তারা ক্লিনফিড না দিলে আমাদের কিছু করার নেই। আমরা ডিস্ট্রিবিউটরদের কাছ থেকে বিদেশী চ্যানেল নিয়ে এসে দর্শকদের কাছে পৌঁছে দেই। ব্রডকাস্টার যদি ক্লিনফিড দেয় তাহলে আমরা সেটাই দেবো। অনেক ধরণের টেকনোলজি আছে চ্যানেলকে বিজ্ঞাপনমুক্ত করার বা ব্লক করার কিন্তু সেটা করার এখতিয়ার আমাদের নেই।

 

ছবি : সংগৃহীত

এদিকে, চট্টগ্রামের ক্যাবল অপারেটর নিজাম উদ্দিন মাসুদ প্রযুক্তিগত অদক্ষতা থাকলেও ক্লিনফিড বাস্তবায়নে শুধু ক্যাবল অপারেটরদের দায় নেই উল্লেখ করে বিজেসি নিউজকে বলেন, ‘করোনার কারণে দুই বছর আমরা কোনো ধরণের আধুনিক যন্ত্রপাতি আমদানি করতে পারিনি। এখন কষ্ট হলেও আমরা ম্যানুয়ালি চেষ্টা করছি। চ্যানেল বিজ্ঞাপনমুক্ত করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়, এটা ব্রডকাস্টারদের কাজ। আমরা শুধু এটা গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দেই। সমস্যা সমাধানে আমরা ব্রডকাস্টার এবং পরিবেশকদের সাথে কথা বলছি। এটি আমাদের ব্যবসার স্বার্থেই আমরা করছি। আশা করছি শিগগিরি সংকটের সমাধান হবে’।

 

বিদেশী চ্যানেল বন্ধ থাকায় টেলিভিশন দর্শকের সংখ্যা কমতে পারে?

বিদেশি চ্যানেল বন্ধ থাকায় বাংলাদেশের টেলিভিশনের দর্শকের সংখ্যা কমে যেতে পারে বলে আশংকা করছেন অনেকে। এ বিষয়ে কোয়াবের যুগ্ম আহবায়ক সৈয়দ মোশারফ আলী জানান,  তারা গ্রাহকদের চাপের মধ্যে আছেন। মাসিক যে বিলটা তারা আদায় করেন তা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

তিনি বলেন, ‘মানুষ টেলিভিশন বাদ দিয়ে অন্যান্য প্লাটফর্মের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে। এভাবে চললে আমাদের দীর্ঘদিনের এই সেটআপ নষ্ট হয়ে যাবে, এমনকি ব্যবসাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে’।

তবে সময় টিভির সম্প্রচার ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রধান সালাউদ্দিন সেলিম মনে করেন টেলিভিশনের রিমোট হাতে নিয়ে টিভি দেখা এ দেশের মানুষের নেশা। তাই টেলিভিশন দেখাটা কমবে না। বরং সরকারের বর্তমান অবস্থান অনুযায়ী বাংলাদেশী চ্যানেলের দর্শক বাড়বে এবং চ্যানেলগুলো স্বাবলম্বী হবে।

তবে এক্ষেত্রে ওটিটি প্লাটফর্মের মাধ্যমে যেসব ভারতীয় চ্যানেল বাংলাদেশে চলছে সেগুলোও এখন বন্ধ করে দেয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।

 

ছবি : সংগৃহীত

সমাধানের উপায় কী?

কোয়াবের যুগ্ম আহবায়ক সৈয়দ মোশারফ আলী মনে করেন, সমস্যা সমাধানে সরকার, পরিবেশক, ব্রডকাস্টারদেরই দায়িত্বটা পালন করতে হবে। তবে এজন্য সময় দরকার এবং বেশ কিছু প্রযুক্তিগত উন্নয়ন দরকার। মধ্যবর্তী সময়ে কার্টুন চ্যানেল, খেলার চ্যানেল, ডকুমেন্টরি বা বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না এমন চ্যানেল চালাতে দেয়া যেতে পারে।

এ বিষয়ে সময় টিভির সম্প্রচার ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রধান সালাউদ্দিন সেলিম বলেন, ‘খরচ ছাড়া সহজ সমাধান করতে চাইলে কূটনৈতিক পর্যায়ে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। যদি বিদেশি চ্যানেলগুলো আমাদের ক্লিনফিড না দেয় সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে আমরা এসসিটিই নামে একটি প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারি যেটি একটি অ্যাড মার্কার সিস্টেম। এর মাধ্যমে বিদেশী চ্যানেলগুলো যখন বিজ্ঞাপনে ঢুকবে তখন এই প্রযুক্তি সেটা শনাক্ত করবে এবং এখান থেকে বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেয়া যাবে’।

ছবি : সংগৃহীত

তবে অ্যাড মার্কার সিস্টেম ব্যয় সাপেক্ষ উল্লেখ করে তিনি বলেন, পরিবেশকরা প্রথমে বক্স দিলেও অ্যাড মার্কার প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হলে নতুন বক্স ক্যাবল অপারেটরদের নিজস্ব অর্থায়নে বসাতে হবে। এছাড়া, আরেকটা উপায় হচ্ছে আমাদের বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে এটাকে রি-আপলিংক করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে একেকটা নেটওয়ার্কের জন্য বা ৯-১০টা চ্যানেল ব্রডকাস্ট করতে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের ২০ মেগাহার্জের উপরে ব্যান্ডউইথ লাগবে যেটার খরচ পড়বে মাসে ৬০ লাখ টাকার মতো’।

ক্লিনফিড সমস্যা সমাধানে অনেকে আপদকালীন নানা সমাধানের কথা বললেও সব পক্ষই সরকারের এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছে। ক্যাবল অপারেটরদের পক্ষ থেকে কেউ কেউ সময় চাইলেও প্রযুক্তি ডিজিটাল করার ব্যাপারে সব পক্ষই একমত । ক্লিনফিড বাস্তবায়নে এখন দরকার সব পক্ষের সমন্বিত উদ্যোগ।