বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস : কেমন আছেন সাংবাদিকরা


বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস : কেমন আছেন সাংবাদিকরা

ছবি : সংগৃহীত

 

প্রায় সাত মাস আগে একটা প্রতিবেদন করে বিজেসি নিউজ। যার হেডলাইন ছিল ‘পেশা নিয়ে বিষন্নতায় সাংবাদিকরা’। প্রতিবেদনটি করা হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ -ইউল্যাব ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশনা সংস্থা আইজিআই গ্লোবালের একটি গবেষণায় যে তথ্য প্রকাশ পায় সেটি নিয়ে।

সেই প্রতিবেদনে উঠে আসে প্রায় ৪২.৯ শতাংশ সাংবাদিক তার পেশা নিয়ে কোনো না কোনোভাবে বিষন্নতায় ভুগছেন। এছাড়াও ৭১.০৭ শতাংশ সাংবাদিক এই পেশা ছেড়ে দিতে চান।

ইউল্যাব বাংলাদেশে সংবাদপত্র, স্যাটেলাইট টেলিভিশন ও অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোতে কর্মরত সাংবাদিকদের নিয়ে এ গবেষণা পরিচালিত করে। এতে বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মরত ১৯১ জন সাংবাদিক অংশ নেন। অংশগ্রহণকারী সাংবাদিকদের ৭৯.১ শতাংশই নিজ পেশা নিয়ে সন্তুষ্ট নন। তাদের মধ্যে নারী ৪৮.৪৮ আর পুরুষ ৪১.৭৭ শতাংশ। এই বিষন্নতা এবং চাকরি অসন্তষ্টির সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে উঠে এসেছে চাকরির অনিশ্চয়তা। এই হার ৮৫ শতাংশ। অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—চাকরিতে সময়মতো পদন্নোতি না পাওয়া, কম বেতন এবং মাত্রাতিরিক্ত কাজের চাপ। অনেক মেধাবীই এই পেশায় কিছুদিন কাজ করে ছেড়ে দিয়েছেন, এমন তথ্যও উঠে এসেছে গবেষণায়।

এই গবেষণার নেতৃত্বে ছিলেন ইউল্যাবের মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগের শিক্ষক আমিনুল ইসলাম। এছাড়াও গবেষক দলে আরো ছিলেন একই বিভাগের শিক্ষক ড. সরকার বারবাক কারমাল ও সাবেক শিক্ষার্থী আপন দাস।

পাঠকদের মনে প্রশ্ন আসতে পারে, উপরে পুরনো সংবাদের তথ্যগুলো কেন দেয়া হলো। কারণ আজ বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। সেখানে হাজারো মানুষের মতো মানসিক স্বাস্থ্য অবসাদে আছেন সাংবাদিকরাও। 

সেই গবেষণার গবেষকদলের প্রধান আমিনুল ইসলাম বিজেসি নিউজকে বলেছিলেন, 'যেকোনো পেশাতেই নিজের সেরাটুকু দিতে গেলে মানসিক চাপমুক্ত থাকাটা জরুরি। সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মজার ব্যাপার হচ্ছে সারা পৃথিবীতেই সবচেয়ে বেশি চাপ নিয়ে যেসব পেশায় কাজ করতে হয় সাংবাদিকতা তার অন্যতম। আমাদের দেশে পেশাগত অন্যান্য চাপের (যেমন: নির্দিষ্ট কর্মঘন্টা না থাকা, ডেডলাইনের চাপ ইত্যাদি) সঙ্গে আরও যুক্ত হয় অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সামাজিক চাপ (অনেকেই বলেন, সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে সহজে বাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়না)। তবে এ নিয়ে আমাদের দেশে সচেতনতা খুবই কম। সাংবাদিকদের পেশাগত চাপ ও সন্তুষ্টি নিয়ে তেমন কোনো আলোচনাও চোখে পড়েনা। আমাদের কাছে মনে হয়েছে বিষয়টি আলোচনার দাবি রাখে, বিশেষত: যখন আমাদের গণমাধ্যমগুলো একটা ক্রান্তিলগ্ন পার করছে'।

আজকের লেখায় আমরা দেখবো কীভাবে একজন সাংবাদিক তার কর্মজীবনে মানসিক অবসাদ থেকে মুক্তি পেতে পারেন।

প্রথমেই যেকোনো ট্রমাদায়ক অ্যাসাইনমেন্টে যাওয়ার আগে একজন সাংবাদিক কী করতে পারেন।

প্রথমেই আপনার সম্পাদক বা ম্যানেজারের সাথে অ্যাসাইনমেন্টের সম্ভাব্য মানসিক ঝুঁকি নিয়ে কথা বলুন। তাদের সাথে শেয়ার করুন। সম্পাদক বা ম্যানেজারের দায়িত্ব, সেই ঝুঁকিগুলোকে গুরুত্ব সহকারে নেয়া।

আপনি কীভাবে নিয়মিত অফিসের সাথে যোগাযোগ রাখবেন সেটি আগে থেকেই ঠিক করে রাখুন।

যেকোনো তথ্য আপনি আপনার পরিবারকে জানাতে না পারলেও অফিস যেনো আপনার পরিবারকে আপনার সর্বশেষ তথ্য জানিয়ে দেয়।

আপনি যে এলাকায় অ্যাসাইনমেন্টে যাবেন সেখানে আপনার পরিচিত কেউ থাকলে যোগাযোগ করুন।

যেকোনো সংকট আসতেই পারে, তবে সেগুলোকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখুন। ইতিবাচক এবং আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করুন।

আপনাকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে কাজটি আপনি মন থেকে করছেন, যদি মনে হয় জোর করে করছেন তাহলে অফিসের সাথে কথা বলুন।

এছাড়া, কাজে অথবা অ্যাসাইনমেন্টে থাকার সময় কিছু জিনিস লক্ষ্য রাখুন।

অ্যাসাইনমেন্টে সময় মতো খাওয়ার চেষ্টা করুন। সেটি না হলেও কাজ শেষে খাবার খেয়ে নিন।

শারীরিক স্ট্রেস কমাতে হালকা হাঁটা চলা করা যেতে পারে।

অনেকক্ষণ কাজের মাঝে কিছুটা সময় বিরতি নিন, অন্য সহকর্মীদের সাথে কথা বলুন।

অ্যাসাইনমেন্টে নিজের অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করুন, শারীরিক বা মানসিক সমস্যা হলে অন্যের সাথে শেয়ার করুন।

বিশেষ করে দীর্ঘ অ্যাসাইনমেন্টে বাড়ীতে ফোন করুন, পরিবার, প্রিয়জন এবং সহকর্মীদের সাথে যোগাযোগ বজায় রাখুন।

খুব লম্বা সময় ধরে অদ্ভুত কোনো ছবি বা ভিডিওর দিকে তাকিয়ে থাকবেন না।

আপনার নিউজ টিমের অন্য সদস্যদের সাথে কথা বলুন।

দলের ক্যামেরা অপারেটরের মতামত এবং ধারণাগুলো গ্রহণ করুন। সেগুলো ডেস্কের পাশাপাশি সহকর্মী ফটোগ্রাফার/ক্যামেরা অপারেটরদের সাথে শেয়ার করুন। ফুটেজ মিস নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেন না।

একই সাথে কাজের দিকেও মনোযোগী হতে হবে সাংবাদিকদের। তবে অনেক সময়ই এমন অনেক ধরণের অ্যাসাইনমেন্ট থাকে যা থেকে বের হতে সাংবাদিকদের সময় লাগে। যেমন রানা প্লাজা, হলি আর্টিজেন, জঙ্গি হামলা, রোহিঙ্গা শরণার্থী ইত্যাদি বিভিন্ন অ্যাসাইনমেন্টে কাজ করার পর এমন অনেক সাংবাদিক আছেন যারা দিন, মাস এমন কি বছর পর্যন্ত বিভিন্ন ট্রমায় ছিলেন। এসকল ট্রমার ফলে অনেকের ঘুমের সমস্যা দেখা দিয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন দু:স্বপ্ন দেখেছেন তারা। অনেক সময়ই সাংবাদিকদের কাছে মনে হতে পারে আপনার সাথে খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে। এছাড়াও শারীরিক প্রতিক্রিয়া যেমন ঘাম, দ্রুত হৃদস্পন্দন, মাথা ঘোরা, বমি বমি ভাব ইত্যাদি বিষয় ঘটতে পারে।

সেই গবেষণায় কাজ করা অন্য এক সদস্য ছিলেন ইউল্যাবের শিক্ষক ড. সরকার বারবাক কারমাল। এই গবেষণা রেজাল্টের পরে আমাদের দেশের গণমাধ্যমগুলোর কী করা উচিত বলে মনে করেন এমন প্রশ্ন করা হয়েছিলো তাকে। তিনি জানান, ভালো সাংবাদিকতা যদি আমরা আশা করি সাংবাদিকদের কল্যাণের দিকটিও দেখতে হবে। সাংবাদিকতা পেশা ও সাংবাদিকদের জীবনমান উন্নয়ন প্রশ্নে কর্মক্ষেত্রে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি অবশ্যই গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রথমেই তাদের উচিত কর্মীদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, জরুরি পরিস্থিতিতে সহায়তা (যেমন: কর্তব্যকালীন দুর্ঘটনা) এবং আইনগত সহায়তার বিষয়গুলো নিশ্চিত করা যা তাদের অনেকাংশে চাপমুক্ত হয়ে কাজ করতে সাহায্য করবে। পাশাপাশি, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা রাখা জরুরি।