‘দর্শকদের সমস্যা হলেও ক্লিনফিড কার্যকর হওয়া দরকার’


‘দর্শকদের সমস্যা হলেও ক্লিনফিড কার্যকর হওয়া দরকার’

ছবি : সংগৃহীত

 

রওনক ইসলাম, বিজেসি নিউজ: ক্লিনফিড জটিলতায় সম্প্রতি দেশে বন্ধ রয়েছে সকল বিদেশি চ্যানেলের সম্প্রচার। বিদেশি টেলিভিশন চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ রাখা নিয়ে সরকার, ক্যাবল অপারেটর ও ডিস্ট্রিবিউটরদের মুখোমুখি অবস্থানে বিপাকে পড়েছেন বিদেশি চ্যানেলের নিয়মিত দর্শকরা।

 

দীর্ঘদিন থেকে ক্লিনফিডের দাবি জানিয়ে আসছিলো সম্প্রচার সাংবাদিকদের সংগঠন ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার-বিজেসি। এটি কার্যকর হওয়ায় তথ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগকে স্বাগত জানায় ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার-বিজেসিসহ দেশের বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠন ও দেশের টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন অ্যাটকো। তবে এই উদ্যোগে সন্তুষ্ট নয় ক্যাবল অপারেটরদের সংগঠন-কোয়াব। তারা বলছে সরকারের এই সিদ্ধান্তের কারণে দর্শকদের ইন্টারনেটভিত্তিক বিনোদন মাধ্যমের দিকে ঝুঁকে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

 

এছাড়া, শুধু ৩৪টি দেশি চ্যানেল দিয়ে দর্শক ধরে রাখাও কোনোভাবেই সম্ভব নয়, বলছেন কোয়াবের নেতারা।

 

ক্লিনফিড কার্যকরের উদ্যোগ নিয়ে বিজেসি নিউজ কথা বলেছে সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার ও জাতীয় দৈনিক আজকের পত্রিকার সম্পাদক অধ্যাপক গোলাম রহমানের সাথে।

বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়েছেন তিনি। গোলাম রহমান বলেন, ‘সরকার সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে। টেলিভিশন মালিক ও গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য এটি অবশ্যই ভালো উদ্যোগ।

১ অক্টোবর, শুক্রবার থেকে বাংলাদেশে বিজ্ঞাপনসহ অনুষ্ঠান প্রচার করে, এমন বিদেশি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ রয়েছে। এতে করে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ দর্শক। আবার বিষয়টি নিয়ে অনেকটা সরকার এবং ক্যাবল অপারেটরদের মুখোমুখি অবস্থান লক্ষ্য করা গেছে।

 

এর পরিপ্রেক্ষিতে গোলাম রহমান বলেন, ‘ভালো কিছু উদ্যোগ নিতে গেলে দুই পক্ষ মুখোমুখি অবস্থানে যাবে এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু মুখোমুখি অবস্থানে না গিয়ে ক্যাবল অপারেটরদের এই আইন মেনে নেয়া উচিত। ২০০৬ সাল থেকে ‘ক্যাবল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক পরিচালনা আইন’, রয়েছে। এই আইন এতোদিনেও কার্যকর করা যায়নি, এটি দু:খজনক বিষয়। এই আইন নিয়ে যদি ক্যাবল অপারেটদের সমস্যা থাকে তাহলে তারা তা নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধানে আসতে পারেন। কিন্তু তাদেরকে অবশ্যই আইন মানতে হবে’।

 

দর্শকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘দেশে বিদেশি চ্যানেলের বড় সংখ্যক দর্শক রয়েছে এটি অবশ্য ঠিক। সেক্ষেত্রে যখন চ্যানেলগুলো ক্লিনফিড হবে তখন দর্শকরা আবার চ্যানেলগুলো দেখতে পারবেন। এখানে হয়তো সপ্তাহ খানেক বা ১০-১৫ দিন সময় লাগবে। কষ্ট হলেও এই সময়টুকু দর্শককে মেনে নিতে হবে’।

ছবি : সংগৃহীত

এদিকে, ৩ অক্টোবর, রবিবার ক্লিনফিড ও বিদেশি চ্যানেল নিয়ে হুঁশিয়ারি দিয়ে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, ‘বাংলাদেশে ‘ক্লিনফিড’ পাঠানো সত্ত্বেও বিবিসি-সিএনএনসহ ১৭টি বিদেশি চ্যানেল বন্ধ রেখে শর্ত ভঙ্গ করেছেন ক্যাবল অপারেটররা। তারা শর্ত ভঙ্গের অভিযোগে অভিযুক্ত হবেন’।

 

তবে ক্যাবল অপারেটররা বলছেন, যে চ্যানেলগুলো ক্লিনফিড দেয় সরকার সেগুলোর তালিকা সরবরাহ করলে তারা সেগুলো সম্প্রচার করবে। বিবিসি, সিএনএনে কম হলেও কিছু বিজ্ঞাপন বা বিজ্ঞাপনভিত্তিক অনুষ্ঠান থাকে। যাচাই-বাছাই করে যেসব চ্যানেলে বিজ্ঞাপন থাকবে না, সেগুলো চালু করে দেয়া হবে।

 

বিজ্ঞাপনসহ বিদেশি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধের একদিন পর অর্থাৎ ২ অক্টোবর শনিবার ক্যাবল অপারেটরস সমন্বয় কমিটি নামে কোয়াব-এর একটা অংশ চার দফা দাবি জানিয়ে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেয়। সেখানে বলা হয়, ৪ অক্টোবরের মধ্যে ক্যাবল টিভি নিয়ে জটিলতার অবসান না হলে সমগ্র বাংলাদেশের ক্যাবল অপারেটরদের নিয়ে বৃহত্তর আন্দোলনে যাবেন তারা।

 

ক্যাবল অপারেটরদের সংগঠন কোয়াব-এর একাংশের এই আন্দোলনের হুমকিকে ‘আইন বহির্ভূত’ বলে মন্তব্য করেছেন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ।

 

ক্লিনফিড মূলত টেলিশনে সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানের মাঝে যেসব বিজ্ঞাপন আমরা দেখি সেসব না দেখানো। অর্থাৎ একেবারে বিজ্ঞাপন মুক্ত সম্প্রচার।

 

ক্লিনফিড বা বিজ্ঞাপন মুক্ত বিদেশি চ্যানেলের সম্প্রচার শুধু বাংলাদেশে নয় আশেপাশের অনেক দেশেই এই বিষয়ের প্রচলন রয়েছে। যেমন বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপালেও ক্লিনফিড বা বিজ্ঞাপন ছাড়া বিদেশি চ্যানেলের সম্প্রচার হয়। ইউরোপ-আমেরিকাতেও এর প্রচলন বহু আগে থেকেই।

 

বিজ্ঞাপনমুক্ত ভাবে বিদেশি চ্যানেলের সম্প্রচার হয় দুইভাবে। যেসব বিদেশি চ্যানেল বাংলাদেশে সম্প্রচার হয়, সেসব চ্যানেল নিজেরাই বিজ্ঞাপনহীন করে ডাউনলিংক করার ব্যবস্থা করতে পারে। অর্থাৎ চ্যানেলকেই বিজ্ঞাপনমুক্ত ফিড দিতে হয়। অথবা বাংলাদেশে যারা স্যাটেলাইট থেকে চ্যানেল ডাউনলিংক করে, তারা চ্যানেলের অনুষ্ঠানের মাঝে থাকা বিজ্ঞাপন বাদ দিতে পারে।

 

ক্লিনফিড নিয়ে সরকারের এ উদ্যোগে কেন সন্তুষ্ট নন ক্যাবল অপারেটররা এই প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক গোলাম রহমান বলেন, ‘ক্লিনফিডের বিষয়টি ক্যাবল অপারেটদের স্বার্থবিরোধী। তাদের কাঁচা পয়সা দরকার। কেবল অপারেটররা কোনো নিয়ম-নীতি মানছেন না, পুরোটাই অনিয়মের মধ্য দিয়ে চলছে। কিন্তু এভাবে চলতে পারে না। বিষয়টিকে অবশ্যই একটি নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে’।

 

অন্যদিকে, ক্লিনফিড নিয়ে ক্যাবল অপারেটররা বলছেন, চ্যানেলগুলো বাংলাদেশের জন্য আলাদা ফিড দেবে এটা অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবসম্মত নয়। এতে যদি ওই চ্যানেলের এ দেশে সম্প্রচারে ব্যাপকভাবে আর্থিক লাভের সুযোগ না থাকে, তাহলে সেটি তারা করবে না।

 

কোয়াবের এক সাবেক নেতা জানান, তারা বিদেশি চ্যানেলগুলোর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছেন। চ্যানেলগুলো বিজ্ঞাপনমুক্ত ফিড দিতে আগ্রহী নন। কেননা বাংলাদেশে তাদের বাজার ততোটা বড় নয়।

 

চ্যানেলগুলো নিজেরা না করলে বাংলাদেশে যারা ডাউনলিংক করছে অর্থাৎ কেবল অপারেটর বা ডিটিএইচ সংযোগকারী ও ডিস্ট্রিবিউটরদেরই এটি করতে হবে।

 

কোয়াবের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সারা দেশে প্রায় সাড়ে ৪ হাজারের বেশি ক্যাবল অপারেটর রয়েছেন। বেশিরভাগ অপারেটরের সংযোগসংখ্যা ১৫০-২০০ বা ২৫০-৩০০। চ্যানেল ক্লিনফিড করে চালানো কেবল অপারেটরদের পক্ষে সম্ভব নয়।

 

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রতিটি বিদেশি ব্রডকাস্টার বা চ্যানেল কর্তৃপক্ষ নিজ নিজ চ্যানেল বিজ্ঞাপনমুক্ত করে বাংলাদেশের জন্য ফিড দিলে কাজটা সহজ হয়ে যায়। এজন্য প্রয়োজনীয় সব প্রযুক্তিই তাদের রয়েছে।

ছবি : সংগৃহীত

সরকারি হিসেব অনুযায়ী বিদেশি চ্যানেল বিজ্ঞাপনমুক্ত না হওয়ায় বাংলাদেশ এ খাত প্রতিবছর প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কারণ বাংলাদেশে টেলিভিশন চ্যানেলের দর্শকদের মধ্যে একটি বড় অংশ ভারতীয় বিভিন্ন চ্যানেলের দর্শক। এছাড়া, বেশকিছু বিদেশি চ্যানেলেরও দর্শক রয়েছে। এসব চ্যানেলে বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপন দেখানো হয়। ওই বিদেশি পণ্য বাংলাদেশের বাজারেও বিক্রি হয়। সেক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনগুলো যেহেতু বিদেশি চ্যানেলেই প্রচার করা যাচ্ছে তাই পণ্য আমদানিকারক বা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দেয়ার প্রয়োজন বোধ করেন না বা কম দেন। এতে দেশীয় চ্যানেলগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চ্যানেলগুলো নতুন বিনিয়োগে যেতে পারে না।

 

এছাড়া, বিজ্ঞাপন দেয়ার প্রয়োজন না হওয়ায় নতুন বিজ্ঞাপন তৈরি হয় না। বিজ্ঞাপনী সংস্থায় বিনিয়োগ হয় না। নানাবিধ খাত বিনিয়োগ-বঞ্চিত হয়।

 

বিদেশি চ্যানেল বিজ্ঞাপনশূন্য না হওয়ায় বাংলাদেশের অন্তত ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয় উল্লেখ করে অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন চ্যানেল ওনার্সের (অ্যাটকো) জ্যেষ্ঠ সহ সভাপতি মোজাম্মেল বাবু এক ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার মধ্যে ভ্যাট বা অন্যান্য কর হিসেবে সরকারের প্রাপ্য থাকে এক-চতুর্থাংশ বা ৩০০ কোটি টাকা। আর বাকি অর্থ বিজ্ঞাপন হিসেবে বিভিন্ন টিভি চ্যানেল, পোর্টালের প্রাপ্য। পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে এখন প্রায় কোনো বিদেশি পণ্যের বিজ্ঞাপন পাওয়া সম্ভব হয় না।

 

এদিকে, দেরিতে হলেও বিজ্ঞাপনসহ বিদেশি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ হওয়ায়, সরকারকে স্বাগত জানিয়েছে দেশীয় টেলিভিশন চ্যানেল মালিকদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন চ্যানেল ওনার্স-অ্যাটকো, সম্প্রচার সাংবাদিকদের সংগঠন ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার-বিজেসি, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন-বিএফইউজে এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন-ডিইউজে।

 

পাশাপাশি অবিলম্বে গণমাধ্যমকর্মী আইন প্রণয়ন এবং এই শিল্পের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অন্যান্য পদক্ষেপ নেয়ারও আহ্বান জানানো হয়েছে।

 

এ বিষয়ে অধ্যাপক গোলাম রহমান বলেন, ‘গণমাধ্যমকর্মীদের বিষয়ে এখনও কোনো আইনকানুন তৈরি হয়নি এটি একটি বড় সমস্যা। সম্প্রচার কমিশন হওয়ার কথা ছিল সেটাও এখনো হয়নি। এই বিষয়গুলো সরকারের দৃষ্টিগোচর করতে হবে। গণমাধ্যমকর্মীদেরকেই বিষয়গুলো তুলে ধরতে হবে। এভাবেই যদি চলতে থাকে তাহলে এই শিল্পের বিকাশ হবে না। এ সংক্রান্ত একটি আইন অবশ্যই হওয়া উচিত’।