তথ্য অধিকার আইন দিয়ে ২৭ বছরের পেনশন ডাটা উন্মোচন করলেন সাংবাদিকরা


তথ্য অধিকার আইন দিয়ে ২৭ বছরের পেনশন ডাটা উন্মোচন করলেন সাংবাদিকরা

ছবি : সংগৃহীত

 

ব্রাজিল সরকার যেন সরকারি পেনশন ও অবসর ভাতাসংক্রান্ত সব ধরনের নথিপত্র উন্মুক্ত করে, সে জন্য একটি লড়াই চলছিল ২০১৭ সাল থেকে। এই লড়াইয়ের সম্মুখ সারিতে ছিল জিআইজেএনের সদস্য সংগঠন ফিকে সাবেন্দো। সাংবাদিকতার এই সংগঠন বিশেষভাবে কাজ করে তথ্য অধিকার আইন (পর্তুগিজ ভাষায় সংক্ষেপ রূপ- LAI) নিয়ে। ফলাফল? ৭০টি প্রতিবেদন এবং আরও আসছে।

ফিকে সাবেন্দোর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক মারিয়া ভিতোরিয়া রামোস, ল্যাটএম জার্নালিজম রিভিউকে (এলজেআর) বলেছেন, “এটি দেখানোই আমাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল যে, তথ্য অধিকার আইনকে (লাই) প্রাত্যহিক সাংবাদিকতার কাজেও ব্যবহার করা যায়। তবে লাই নিয়ে কাজ সময়সাপেক্ষ। এটি নিয়ে কাজ করতে গেলে আপনাকে প্রতিনিয়ত শত শত আবেদন পাঠাতে হবে এবং সেগুলোর খোঁজখবর রাখতে হবে।”

ব্রাজিলে তথ্য অধিকার আইন পাস হয় ২০১১ সালে। ১৯৮৮ সালে আইনটি অনুমোদন করেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট দিলমা রুসেফ। এর উদ্দেশ্য ছিল, সংবিধানে তথ্য অবমুক্ত করার যে বাধ্যবাধকতা আছে, সেটি যেন দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার ও সংস্থাগুলো বাস্তবায়ন করে। এই আইন অনুযায়ী, সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন, অবসর ভাতা ও পেনশন-সংক্রান্ত তথ্যও প্রকাশ করার কথা। তবে ট্রান্সপারেন্সি পোর্টালে এত দিন ধরে শুধু চাকরিরত কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতার তথ্যই প্রকাশ করা হচ্ছিল। “ইনঅ্যাকটিভ” হিসেবে বিবেচিত ব্যক্তিদের ব্যাপারে কোনো তথ্য ছিল না। 

“পেনশনভোগী মানুষদের সম্পর্কে জানতে আমরা ২০১৭ সালে প্রথম একটি অভিযোগ দায়ের করেছিলাম টিসিইউ-তে” (ব্রাজিলের কেন্দ্রীয় জবাবদিহি অফিস)। তখনো আমাদের জানা ছিল না যে, কারা পেনশন পাচ্ছেন এবং এই খাতে সরকার কত খরচ করছে। এটি ছিল পুরোপুরি ধোঁয়াশাচ্ছন্ন একটি জায়গা,” সেই সময়ের কথা স্মরণ করে বলছিলেন রামোস। 

২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে, টিসিইউর একটি সিদ্ধান্তের ফলে এসব তথ্য প্রকাশ করতে বাধ্য হয় সরকার। যদিও সেটি করা হয়েছিল দুই মাস পর। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ডোন্ট লাই টু মি নিউজলেটারে এই ডেটা প্রাপ্তির সংবাদ ঘোষণা করে ফিকে সাবেন্দো। কিন্তু দ্রুতই তাদের বেশ কিছু সংশোধনী আনতে হয়। 

“আমাদের জন্য কোনো নিশ্ছিদ্র বিজয়ের সুযোগ ছিল না। সরকার বলেছিল, তারা কেন্দ্রীয় সরকারের আওতাধীন সব পেনশনের তথ্য উন্মুক্ত করেছে। কিন্তু আমাদের প্রথম নিউজলেটার প্রকাশিত হওয়ার পর আমরা টুইটারে মেসেজ পেতে থাকি: ‘আমি এটি দেখেছি, কিন্তু আমার কোনো পেনশনভোগী আত্মীয়ের নাম পাইনি।’ এরপর আমরা আবিষ্কার করি যে, সরকার পুরো ডাটা প্রকাশ করেনি,” বলেন রামোস। 

সরকার পেনশন-সংক্রান্ত সব ডাটা প্রকাশের ঘোষণা দিলেও তালিকাটি ছিল অসম্পূর্ণ। ব্রাজিলের তথ্য কমিশন (এবিন), কেন্দ্রীয় ব্যাংক (বিসি) ও সশস্ত্র বাহিনীতে চাকরিজীবীদের তথ্য সেখানে ছিল না। 

তা সত্ত্বেও, প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হওয়া এই অসম্পূর্ণ ডাটা থেকেই বেশ কিছু প্রতিবেদন তৈরি করেছে ব্রাজিলের সংবাদমাধ্যম। প্রথমবারের মতো তারা এমন সব তথ্য সামনে এনেছে, যেগুলো আরও অনেক আগেই সবার জানা উচিত ছিল। যেমন পিয়াউই ম্যাগাজিনের রিপোর্টাররা দেখিয়েছেন, কেন্দ্রীয় রাজস্ব বিভাগের এক কর্মকর্তার বংশধরেরা পেনশন পেয়েছেন ১০৭ বছর ধরে। সেই ব্যক্তি মারা গিয়েছিলেন ১৯১২ সালে (সে সময় তাঁর পদটির নাম ছিল কাস্টমস ট্রেজারার)। ২০১৯ সালে তাঁর বংশধরেরা শেষবারের মতো পেনশন তুলেছেন। 

সরকারি চাকরিজীবীদের পেনশনের পুরো বিবরণও প্রকাশ করেনি সরকার। তথ্য জানা গেছে শুধু সাম্প্রতিক সময়ের। অন্যভাবে বললে, লড়াইটা ছিল দুই ফ্রন্টে: ঐতিহাসিক তথ্যের জন্য এবং এবিন, বিসি ও সশস্ত্র বাহিনীর ডেটার জন্য।

এসব তথ্য-উপাত্ত পাওয়ার জন্য তথ্য অধিকার আইনের আওতায় আবেদন দাখিল চলতে থাকে ২০২০ সালের মে পর্যন্ত। সে সময় উন্মুক্ত করা হয় ১৯৯৪ সাল থেকে পেনশন পাওয়া সব অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবীর তথ্য। ব্রাজিলে তথ্য অধিকার আইন ব্যবহার করে এত বড় আকারের ডেটাসেট পাওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম।

“সেখানে মোট ২৭টি ফাইলে ১০০ মিলিয়নের বেশি লাইনের ডেটা ছিল। সিএসভি ফরম্যাটে এটির সাইজ ছিল ৬০ গিগাবাইট। আমরা এটি এক্সেলের মতো সাধারণ সফটওয়্যার দিয়ে খুলতে পারিনি”, বলেছেন রামোস।

ডাটাগুলো পরিষ্কার করে একটি সার্চযোগ্য ভিজ্যুয়ালাইজেশন তৈরির জন্য দুজন ডাটা বিজ্ঞানীকে নিয়োগ দেয় ফিকে সাবেন্দো, যেন সাংবাদিকেরা সেটি সহজে ব্যবহার করতে পারেন। 

এই প্রকল্পে কাজ করা একজন ডেটা বিজ্ঞানী, ফার্নান্দো বারবালো, এলজেআর-কে বলেছেন, “এটি ছিল বিশাল এক ডেটাবেস। ১৯৯৪ থেকে ২০২০, ২৭ বছরের ডাটা। আমাকে এটি প্রসেস করতে হয়েছে, ভুলত্রুটি খুঁজে বের করতে হয়েছে এবং ভিজ্যুয়ালাইজেশন তৈরি করতে হয়েছে। এই ধরনের ডাটা নিয়ে কাজ করা কঠিন। আমরা এসব ডেটায় লক্ষ্য করার মতো বেশ কিছু জিনিস খুঁজে পেয়েছি।”

বেশ কয়েকটি ফাইলে থাকা বিশৃঙ্খল ডাটাগুলোকে একটি ডায়নামিক ও সহজে ব্যবহারযোগ্য অনলাইন টুল বানানোর দায়িত্বটি দেওয়া হয় ডেটা বিজ্ঞানী আলভারো জাস্টিনকে; যেন রিপোর্টার, গবেষক ও নাগরিকেরা সহজে তা ব্যবহার করতে পারেন। এর ফলস্বরূপ, বেশ কিছু ভুলত্রুটি শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে, যেগুলো শেষ পর্যন্ত সরকারের নজরে এসেছে এবং সরকার ডেটাগুলোকে আরও উন্নত ও হালনাগাদ করেছে। 

ফিকে সাবেন্দোর হিসাব অনুযায়ী, এভাবে প্রায় ৪ দশমিক ৯ বিলিয়ন ব্রাজিলিয়ান রিয়ালের (৪৯ মিলিয়ন ইউএস ডলার) অনিয়ম শনাক্ত করা হয়েছে।

রামোস বলেন, “এক লাখ রিয়ালের বড় পেমেন্টগুলো দিয়ে আমরা একটি স্প্রেডশিট বানিয়েছি এবং প্রতিটি পেমেন্ট আলাদা করে খেয়াল করেছি। ১৫টি গুরুতর কেসের ক্ষেত্রে, মানবসম্পদ বিভাগ (এইচআর) ইচ্ছা করে ভুল ডেটা প্রবেশ করিয়েছে। এবং বড় যে ভুলটি আমরা শনাক্ত করেছি, সেটি ছিল ডেটাে এক্সট্র্যাকশনে (তুলে আনা),” যেটি করা হয়েছে খোদ সরকারি ব্যবস্থার মাধ্যমে। 

এসব ভুলত্রুটির কথা সরকারকে জানানো হয় এবং পরবর্তী সময়ে সেগুলো ডাটাবেসে সংশোধন করা হয়। “এখানে কী ঘটছে তা জানতে কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলেন কারিগরি খাতের কিছু মানুষ,” বলেন ফিকে সাবেন্দোর এই পরিচালক।

“নাগরিক সমাজের কাছে এসব ডাটার দখল থাকলে, সরকারের যে একটি সুবিধা হবে, তা হলো: এসব ডাটার অনেক মানোন্নয়ন ঘটবে এবং বিভিন্ন নীতিমালা তৈরি, বৈধতা অর্জন ও তথ্য বিশৃঙ্খলা কমানোর ক্ষেত্রে আরও ভালো তথ্যপ্রমাণ পাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে,” বলেছেন বারবালো। তিনি  স্বচ্ছতা ও উন্মুক্ত ডাটা নিয়েও গবেষণা করেন। 

এসব ডেটা প্রক্রিয়াজাতের পাশাপাশি, চারজন সাংবাদিকের একটি সহযোগিতামূলক টাস্কফোর্সও সমন্বয় করেছে ফিকে সাবেন্দো, যাদের কাজ ছিল এই ডাটাবেস ব্যবহার করে প্রতিবেদন তৈরি করা।

“আমরা জানতাম যে, এসব ডাটা নিয়ে রিপোর্ট করার মতো পর্যাপ্ত রিসোর্স ফিকে সাবেন্দোর নেই। তাই আমরা তথ্য অধিকারের ওপরই বেশি মনোযোগ দিয়েছি,” বলেছেন রামোস। 

এই প্রকল্পে সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন গ্যাজেটা দো পোভোর রিপোর্টার লুসিও ভাজ।

তিনি এলজেআর-কে বলেছেন, “আমি টানা চার বছর ধরে রিপোর্টিং করছিলাম নাগরিক ও বিশেষভাবে সামরিক পেনশন নিয়ে। কিন্তু আমি বেশ জটিলতার মুখে পড়েছি। নিজে নিজে কিছুটা এগিয়েছিলাম, কিন্তু সেটি যথেষ্ট ছিল না।”

তথ্য অধিকার আইনের সহায়তায় লাগাতার কিছু আবেদনের মাধ্যমে, ভাজ জানতে পেরেছিলেন সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের পেনশন ও অবসর ভাতা বাবদ মোট কত টাকা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বয়সভিত্তিক গ্রুপ ধরনের কিছু জনমিতিক উপাত্ত-ও তিনি পেয়েছিলেন। তবে পেনশনভোগীদের নাম ও ব্যক্তিভেদে টাকার পরিমাণসহ কয়েকটি ক্ষেত্রে বিস্তারিত তথ্য দিতে রাজি হয়নি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।

“এই জায়গায় ফিকে সাবেন্দো দুর্দান্ত একটি ভূমিকা রেখেছে। তারা এমন আইনি সহায়তা দিয়েছে, যা আমার কাছে ছিল না,” বলেছেন ভাজ। পেনশন-সংক্রান্ত ডেটাবেস প্রকাশের পর তিনি এরই মধ্যে ১৫টি প্রতিবেদন লিখেছেন। একটিতে দেখা যায়, সবচেয়ে “দীর্ঘ সময় ধরে চলা” পেনশন হলো একজন কেন্দ্রীয় কর্মকর্তার একমাত্র কন্যার জন্য। ২০২১ সালে এই পেনশন ১০০ বছর পূর্ণ করেছে। 

জুলাইয়ের শুরুতে আরেকটি বিজয় পায় ফিকে সাবেন্দো। সরকার উন্মুক্ত করে সামরিক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পেনশনভোগীদের ডাটা। এবার ডাটাগুলো ট্রান্সপারেন্সি পোর্টালে এমনভাবে যোগ করা হয়, যেন একজন সাধারণ ব্যবহারকারীও সেখানে সার্চ করে দেখতে পারেন। এবিন সম্পর্কে তথ্য অবশ্য এখনো গোপন রাখা হয়েছে। 

এজেন্সিয়া পুবলিকার রিপোর্টার ব্রুনো ফনসেকা, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের পেনশন ও অবসর ভাতার ডাটা নিয়ে কাজ করে দেখিয়েছেন: স্বৈরতন্ত্রের আমলে করা নানা অপরাধে অভিযুক্তদের উত্তরাধিকারীরা প্রতি মাসে ব্রাজিলিয়ান সরকারের কাছ থেকে ১ দশমিক ২ মিলিয়ন রিয়াল (২ লাখ ৩০ হাজার ডলার) পেয়েছে।

“কেন্দ্রীয় সরকার অনেক দিন ধরেই ডাটাবেসগুলো উন্মুক্ত করতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছিল। এর বিরুদ্ধে ফিকে সাবেন্দো যে আইনি বিজয়টি পেয়েছে, তার ফলেই এই রিপোর্টগুলো করা সম্ভব হয়েছে,” এলজেআর-কে বলেছেন ফনসেকা। “আমিও আগে একবার তথ্যের জন্য আবেদন জানিয়ে সাড়া পাইনি। আরও অনেক সাংবাদিকও ব্যর্থ হয়েছেন। এমনকি এখন পর্যন্ত, ডাটাবেসটি জনসাধারণের সামনে আসত না, যদি না ফিকে সাবেন্দো এই আইনি বিজয়টি পেত।”

ফিকে সাবেন্দোর দলটি দশজনের। তবে মাত্র একজন কাজ করেন পূর্ণকালীন কর্মী হিসেবে। ২০২১ সালের জন্য তাঁদের বার্ষিক বাজেট ছিল ২ লাখ ৮৮ হাজার রিয়াল (৫৫ হাজার ডলার)। প্রতিষ্ঠানটি তথ্য অধিকার আইনের আওতায় কেন্দ্রীয় সরকার, অন্যান্য ক্ষমতাকেন্দ্র ও ফেডারেটিভ ইউনিটের কাছে বছরে গড়ে দু-তিন হাজার আবেদন পাঠায় এবং সেগুলো নজরদারিতে রাখে। 

নোট: ব্রাজিলে কেন্দ্রীয় সরকারের স্বচ্ছতার জন্য দায়বদ্ধ প্রতিষ্ঠান, অফিস অব দ্য কম্পট্রোলার জেনারেলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল এলজেআর-এর পক্ষ থেকে। কিন্তু সাক্ষাৎকারের আবেদন গ্রহণ করা হয়নি। 

(মূল লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল নাইট সেন্টারের ল্যাটিন আমেরিকান জার্নালিজম রিভিউয়ে। সেটি পুনপ্রকাশ করে গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম নেটওয়ার্ক-জিআইজেএন। লেখাটি বিজেসি পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো।)