তালেবানের আনাগোনায় স্তব্ধ কাবুলের গানের স্কুল
২৮ আগস্ট ২০২১, ০৭:৫৬ পিএম
তালেবানরা আফগানিস্তান দখলের পর মুখ থুবড়ে পড়েছে সেখানকার সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা। যেসব সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র আগে মুখরিত থাকত নাচ-গানে সেসব এখন শূন্য পড়ে আছে। আফগানিস্তানের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মিউজিক (এএনআইএম) স্কুলটিতে এখন প্রায়ই ঘোরাফেরা করতে দেখা যায় তালেবানদের। এক প্রতিবেদনে এএনআইএম স্কুলটির এই চিত্রের কথা জানায় বিবিসি।
বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে শিক্ষার্থীরা ভীত ও উদ্বিগ্ন উল্লেখ করে এএনআইএম স্কুলটির পরিচালক ড. সরমাস্ট বলেন, ‘তাদের বুঝতে বাকি নেই যে গানের স্কুলে ফিরে গেলে তাদের শাস্তি দেয়া হবে। তালেবান শাসন কায়েমের পর ঘরে বাদ্যযন্ত্র রাখাকে শিক্ষার্থীরা বিপজ্জনক মনে করছে। কয়েকজন শিক্ষার্থী স্কুলে তাদের বাদ্যযন্ত্র ফেরত দিতে বাধ্য হয়েছে’।
ছবি : সংগৃহীত (ফাইল)
স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক ড. আহমদ সরমাস্ট প্রথম আফগান, যিনি অস্ট্রেলিয়ায় সংগীত বিষয় নিয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। সরমাস্ট ১৯৯০ সালে তালেবান শাসনের সময় আফগানিস্তান ছেড়ে রাশিয়ার মস্কোতে পালিয়ে যান। পরে আবার আফগানিস্তানে ফেরেন। আফগানিস্তানে এক আত্মঘাতি বোমা হামলায় ২০১৪ সালে আহত হন সরমাস্ট। বেশ কিছুদিন তিনি বাক প্রতিবন্ধী ছিলেন।
পরবর্তীতে প্রথাগত ও পাশ্চাত্যধারার সংগীতের মিশেলে নতুন ঘরানায় আফগান শিক্ষার্থীদের গান শেখানো শুরু করেন তিনি।
এই স্কুলটি এক দশক আগে সরমাস্টের নেতৃত্বে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের প্রতিষ্ঠিত হয়। অনাথ ও আশ্রয়হীন শিশুদের সেখানে যোগ দিতে উৎসাহিত করতেন তিনি। এই স্কুল থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনকারীদের অনেকে এখানেই প্রথম আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তালেবানের শাসনকালের পরে ওই গানের স্কুলে ক্লাস শুরু করেন সরমাস্ট।
ছবি : সংগৃহীত (ফাইল)
আফগানিস্তানের প্রথম নারী অর্কেস্ট্রা শিল্পী জোহরা এই এএনআইএম স্কুলের শিক্ষার্থী। গানের স্কুলটি তাঁর কাছে ছিল নিজের বাড়ির মতো। স্লোভাকিয়াতে এক উৎসবে আফগানিস্তানের প্রথম নারী শিল্পী হিসেবে যোগ দেন জোহরা। এই স্কুলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। জোহরা স্বপ্ন দেখতেন নামকরা সংগীতশিল্পী হওয়ার।
দেশটি আবার তালেবান শাসন ফিরে আসায় স্কুল ও সংগীতশিল্পীদের জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। জহুরার সেই স্বপ্নও ভেঙে গেছে।
গত জুলাইয়ে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন সফরে যান সরমাস্ট। সেখান থেকেই বিবিসির সঙ্গে কথা হয় তার। সরমাস্ট বলেন, ‘এখন আমাদের স্বপ্ন, আশা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সব নষ্ট হতে বসেছে।’
সরমাস্ট বলেন, গানের স্কুলের শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয় পাচ্ছেন। এই ভয় কেবল তাদের পড়াশোনা বা সংগীতশিক্ষা নিয়ে নয়। তারা তাদের জীবন নিয়ে শঙ্কিত। আফগানিস্তানে তারা নিজেদের নিরাপদ মনে করছেন না।
ড. সরমাস্ট বলেন, ‘তালেবানরা তাদের গানের স্কুলকে হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। তারা এখানে ঘোরাফেরা করছে। তবে স্কুলের কোনো ক্ষতি করেনি’।
তালেবানরা গানের স্কুলের শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তাদের কাছ থেকে স্কুলের দখল নিতে চাইছে। তবে সরমাস্ট বলেছেন, তিনি কেবল তালেবানদের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করতে চান।
গানের স্কুলে থাকা অনেক বাদ্যযন্ত্র নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, যারা গানবাজনার সঙ্গে জড়িত, তাদের কঠোর শাস্তি দিতে চায় তালেবানরা।
সংগীতশিল্পীদের অনেকে লুকিয়ে আছেন।
ছবি : সংগৃহীত (ফাইল)
তবে তালেবানরা বলছে, আফগানিস্তানের নতুন সরকার বেশি আধুনিক হবে। তারা নারী স্বাধীনতা ও সরকারি কর্মীদের সুরক্ষা দেবে বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
ড. সরমাস্ট বলেন, তিনি আশাবাদী যে তালেবানরা অতীত থেকে শিক্ষা নেবে। কিন্তু কাবুলে এখন যা ঘটছে, তাতে তিনি অনেকটাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।
তবে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে গানের চর্চা ছেড়ে না দেয়ার আহ্বান জানান সরমাস্ট। আফগান সংগীতশিল্পীদের তিনি গানের চর্চা চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। আফগানিস্তানের সংগীতশিল্পীদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার জন্য আহ্বান জানান ড. সরমাস্ট।