সাংবাদিকদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার ‘টিপস’


সাংবাদিকদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার ‘টিপস’

ছবি : সংগৃহীত

 

বিশ্বজুড়েই বিভিন্ন চ্যালেঞ্জিং ইভেন্টের প্রথম সারিতে থাকেন সাংবাদিকরা । সড়ক দুর্ঘটনা থেকে শুরু করে অপরাধের ঘটনাস্থল, প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে যুদ্ধ। যেকোনো চ্যালেঞ্জিং ইভেন্টের সংবাদ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে ছুটে চলেন সাংবাদিকরা। করোনা মহামারিতে অন্য পেশার মানুষ যখন ঘরে অবস্থান করছে সেখানে সাংবাদিকরা করছেন ওভারটাইম।

বড় আন্তর্জাতিক ঘটনা কিংবা বাড়ির কাছাকাছি কোন ঘটনা, নিত্যনতুন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে রিপোর্টিং সাংবাদিকদের মনের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। এর ফলে কিছু ক্ষেত্রে উদ্বেগ, মানসিক চাপসহ পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD) এর মতো সমস্যাও দেখা দিতে পারে।

আইজে নেট-এর এক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এ তথ্য। কয়েক মাস আগে, সাংবাদিকদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন আইজে নেটের সদস্যরা। এরই ধারাবাহিকতায় আইজে নেট এর এডিটর টেইলর মুলকাহির পরিচালনায় সাংবাদিকদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক একটি ওয়েবিনারের আয়োজন করা হয়। ওয়েবিনারে এ বিষয়ে কথা বলার জন্য ছিলেন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ডার্ট সেন্টার ফর জার্নালিজম অ্যান্ড ট্রমা -এর নির্বাহী পরিচালক ব্রুস শ্যাপ্রিও এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়া প্রশিক্ষক শেরি রিচার্ডি।

ওয়েবিনারে শ্যাপ্রিও এবং রিচার্ডি ট্রমা সাংবাদিকতার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে ব্রিফ করেন। সেইসাথে, কীভাবে নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখা যাবে, দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নেয়ার সময় কী করা উচিত এবং নিউজরুমের পরিবেশে নিজেকে কীভাবে মানসিক চাপ থেকে মুক্ত রাখা যায় এসব বিষয় নিয়ে পরামর্শ দেন।

ছবি : সংগৃহীত

সাংবাদিকরা কীভাবে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখতে পারেন সে বিষয়ে শ্যাপ্রিও এবং রিচার্ডির পরামর্শ বিজেসি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো:

 

মনে রাখবেন আপনি মানসিক প্রভাব থেকে মুক্ত নন:

রিচার্ডি বলেন, যখন কোনো সমস্যা হয়, অন্যরা হয়তো সেসময় সেখান থেকে সরে যায় কিন্তু সাংবাদিকরা সেদিকেই ছুটে যায়। নিজেকে প্রাণবন্ত এবং সক্রিয় রাখার জন্য সাংবাদিকরা হয়তো কঠিন পরিস্থিতিতেও স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেন। কিন্তু এটি মনে রাখা জরুরি যে সময়ের সাথে মনে চাপ সৃষ্টি হতে পারে।

শ্যাপ্রিও আরো বলেন, বর্তমান মহামারি প্রতিনিয়তই সবাইকে চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতির সম্মুখীন করেছে। তবে সাংবাদিকদের পেশাতে বিভিন্ন ট্রমার সাথে মানিয়ে চলতে হয় বলে মনে করেন তিনি। সেজন্য নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে কাজ করার পরামর্শ দেন শ্যাপ্রিও । মানসিক চাপ পড়ছে কিংবা কোনো বিষয় সহজভাবে গ্রহণ করতে সমস্যা হচ্ছে এমন মনে হলে দ্রুত কারও সাহায্য নেয়ার পরামর্শ দেন শ্যাপ্রিও।

 

আপনার লক্ষণগুলো চিনুন:

আমরা কোন বিষয়গুলো ভালভাবে মোকাবেলা করতে পারি এবং কোনক্ষেত্রে পারিনা সেগুলো নিয়ে ভাবার কথা বলেন শ্যাপ্রিও। কারো কোনো বিষয়ে দুর্বলতা থাকে আবার কারো কোনো বিষয়ে থাকে পারদর্শীতা। শ্যাপ্রিও এগুলো নোট করে রাখার কথা বলেন। পরবর্তীতে এই বিষয়গুলো মাথায় রেখে কীভাবে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে তা আগে থেকেই পরিকল্পনা করার পরামর্শ দেন।

 

পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিয়ে নিজের মানসিক চাপ কমানোর চেষ্টা করুন:

শ্যাপ্রিও বলেন সাংবাদিকরা কতোটুকু মানসিক চাপ নেন তা অনুমান করা যায়। তবে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ মানসিক চাপ স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ নয় বলে মনে করেন তিনি। যেমন দ্রুত হেডলাইন দেয়া কিংবা কোন রিপোর্ট করার সময় মানসিক চাপ। তবে, অতিরিক্ত মানসিক চাপ হিতে বিপরীত হতে পারে বলেও শঙ্কা জানান তিনি। সেজন্য সাংবাদিকদের পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেয়ার প্রতি জোর দেন। পর্যাপ্ত বিশ্রাম কিংবা নিজের মতো করে ছুটির দিন উপভোগ করলে তা একজন সাংবাদিককে মানসিক প্রশান্তি দেয় এবং কাজেও মনোযোগ বাড়ায় বলে মনে করেন শ্যাপ্রিও । এছাড়া, সারাদিনের কাজের ফাঁকেও ছোট ছোট বিরতি নেয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

ছবি : সংগৃহীত

রুটিন করে নিজের খেয়াল রাখুন:

কর্মব্যস্ত জীবনে আমরা নিজের খেয়াল রাখতেই ভুলে যাই। সেজন্য সাংবাদিকদের রুটিন অনুযায়ী নিজের যত্ন নিতে পরামর্শ দেন শ্যাপ্রিও। রোজই কোন শারীরিক কসরত কিংবা যোগব্যায়াম অথবা একটু হাঁটতে বলেন তিনি। সেইসাথে, অবসরে শুধু সোশ্যাল মিডিয়া কিংবা ডিভাইস নিয়ে বসে না থাকতে বলেন তিনি। সবশেষ, সাংবাদিকদের ঘুমের অন্তত ১ ঘন্টা আগে সবধরণের ডিভাইস থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেন শ্যাপ্রিও এবং রিচার্ডি।

নিজেদের পাশাপাশি বিভিন্ন রিপোর্টের জন্য যাদের ইন্টারভিউ নেয়া হয় তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকেও যেন সাংবাদিকরা খেয়াল রাখেন সে বিষয়ে পারমর্শ দেন রিচার্ডি এবং শ্যাপ্রিও। এ বিষয়ে তারা পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক হান্নাহ ড্রেইয়ারের সাথেও কথা বলেন।

কীভাবে সোর্সের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রেখে সাক্ষাৎকার নিতে হবে সে বিষয়ে কিছু পরামর্শ দেন হান্নাহ।

 

সাক্ষাৎকারের সময় সোর্সকে নিজের মতো করে কথা বলতে দেয়া:

সাক্ষাৎকারের সময় সোর্সকে নিজের মতো করে সহজ ভাষায় কথা বলতে দেয়ার সুযোগ দিতে হবে। যেকোনো দুর্ঘটনার ভুক্তভোগী যদি সাক্ষাৎকার দেন তাকে সহজ হয়ে কথা বলার জন্য সময় দেয়ার পরামর্শ দেন হান্নাহ। এতে হয়তো সাংবাদিকদের সময় বেশি দিতে হবে তারপরো সোর্সকে নিজের মতো করে কথা বলতে দেয়া দরকার বলে মনে করেন পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত এই সাংবাদিক।

 

নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিতে হবে:

সাক্ষাৎকারের জন্য নিরাপদ স্থান এবং সময় ঠিক করার ওপর গুরুত্ব দেন হান্নাহ।

 

কেন কঠিন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করছেন তা উত্তরদাতাকে বুঝিয়ে বলুন:

যখন আপনি ভুক্তভোগী বা শোকগ্রস্ত পরিবারের সাথে কথা বলছেন, তখন তাদের অবশ্যই জানাতে হবে যে কেনো আপনি তাদের গল্প জানতে চাচ্ছেন, বিশেষ করে সেই গল্প যদি হয় তাদের কোনো তিক্ত অভিজ্ঞতার।

ছবি : সংগৃহীত

সাংবাদিকদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার্থে নিউজরুমের ভূমিকা:

মানসিক স্বাস্থ্য প্রোটোকল তৈরি:

রিচার্ডি বলেন সাংবাদিকদের নিরাপত্তায় যেমন প্রটোকল মানা হয় ঠিক তেমনি তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখতে প্রটোকল মানা উচিৎ।

 

নিউজরুমের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য কমিটি গঠন:

অনেকসময় ম্যানেজমেন্ট এই বিষয়ে কোনো গাইডলাইন তৈরি করে না। রিচার্ডি মনে করেন এক্ষেত্রে সাংবাদিকরা নিজেরাই এগিয়ে আসতে পারেন। তিনি বলেন নিউজরুমে মানসিক স্বাস্থ্য কমিটি গঠনের জন্য গবেষণা করে কিছু গাইডলাইন তৈরি করে ম্যানেজমেন্টের কাছে উত্থাপন করতে পারেন সাংবাদিকরা। আর সেক্ষেত্রে সাংবাদিকরা স্বাধীনভাবে নিজেদের মতামত দিতে পারবেন বলেও মনে করেন রিচার্ডি।

 

মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তায় ‘পিয়ার’ প্রোগ্রাম:

মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সহায়তা করতে ‘পিয়ার প্রোগ্রাম’ চালু করার কথাও বলেন শ্যাপ্রিও। এক্ষেত্রে সহকর্মীরা একে অপরকে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা করার মাধ্যমে সমাধান দেবেন।

 

মানসিক স্বাস্থ্য বলতে শুধু অনুভূতিকেই বোঝানো নয়

শ্যাপ্রিও বলেন মানসিক স্বাস্থ্য বলতে অনেক সাংবাদিক কিংবা নিউজরুম লিডার অনুভুতির কথাই ভাবেন। কিন্তু বিষয়টি শুধু অনুভূতিতেই সীমাবদ্ধ নয় বলে মনে করেন তিনি। কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যকে তিনি পেশাগত স্বাস্থ্য বলে উল্লেখ করেন।

 

নিউজরুমে মানসিক স্বাস্থ্য পরিচালনায় শীর্ষস্থানীয় থেকে শুরু করে মিড লেভেলের পরিচালকদের দক্ষতা বাড়ানো:

নিউজরুমে মানসিক স্বাস্থ্য পরিচালনা করতে মিড লেভেলের পরিচালকদের দক্ষতা বাড়ানোর দিকে খেয়াল রাখতে হবে বলে মনে করেন শ্যাপ্রিও। কীভাবে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে হবে, তাদের কথা কীভাবে শুনতে হবে, কীভাবে কোনো সমস্যার সমাধান করতে হবে এসব বিষয়ে তাদের দক্ষতা বাড়ানো দরকার বলে যোগ করেন তিনি।

 

নিউজরুমের সম্পাদকদের পাশাপাশি বাহির থেকে দক্ষ প্রশিক্ষকের ব্যবস্থা করা

সম্পাদকরাই সাংবাদিকদের তাদের কাজ নিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। কোনো বিষয়ে কাজ করার প্রতি যদি সাংবাদিকদের ইচ্ছা থাকে বা কোন কিছু জানার ইচ্ছা থাকে বা প্রশিক্ষণের দরকার মনে করেন তবে সম্পাদকদের পাশাপাশি বাহির থকে দক্ষ প্রশিক্ষক এনে তাদের সেই বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়ার কথাও বলেন শ্যাপ্রিও এবং রিচার্ডি।

 

অনুবাদ: সাবরিনা আফরোজ
সৌজন্য : আইজে নেট