জোটবদ্ধ অনুসন্ধানে এশিয়ায় ডিজিটাল যৌন অপরাধের ব্যাপকতা উন্মোচন


জোটবদ্ধ অনুসন্ধানে এশিয়ায় ডিজিটাল যৌন অপরাধের ব্যাপকতা উন্মোচন

ছবি : সংগৃহীত

 

কম্বোডিয়ার ৩৮ বছর বয়সী এক নারী বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছেন; কারণ, সাবেক প্রেমিক হুমকি দিচ্ছেন, ভবিষ্যৎ স্বামীর কাছে তাঁর অন্তরঙ্গ ছবি পাঠিয়ে দেওয়া হবে। হংকংয়ের এক অফিস-কর্মীকে তাঁরই সহকর্মী ব্ল্যাকমেল করছে, ডেট করতে রাজি না হলে তাঁর একটি পর্নোগ্রাফিক ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হবে, যেটি সম্মতি ছাড়াই ১০ বছর আগে ধারণ করা হয়েছে। ফিলিপাইনের প্রতারকদের কাছে হয়রানির শিকার হচ্ছেন যুক্তরাজ্যের ২০ বছর বয়সী এক শিক্ষার্থী, যিনি গুগল হ্যাংআউটে অন্তরঙ্গ ভিডিও কলের ফাঁদে পড়েছেন । ইমেজ-অ্যাবিউজের (ছবি বা ভিডিওর মাধ্যমে হয়রানি) শিকার হওয়া নারীদের এমন অভিজ্ঞতা তুলে এনেছে এশিয়ার পাঁচটি সংবাদমাধ্যমের এক অনন্য কোলাবোরেশন। এই প্রকল্পের মাধ্যমে তাঁরা ডিজিটাল যৌন অপরাধের গভীরে গেছেন এবং চিত্রভিত্তিক হয়রানির বিভিন্ন স্তর অনুসন্ধান করেছেন। এই অনুসন্ধানের ক্ষেত্র ছিল এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল, যেখানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। প্রকল্পটি নজর দিয়েছে সেক্সটরশন, চিত্রভিত্তিক যৌন হয়রানি ও ডিজিটাল প্রাইভেসিতে। ইস্যুগুলো ক্রমেই উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠছে। কারণ, অনলাইনে আমরা এখন ডেট করছি, একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছি এবং ডিজিটাল মাধ্যমে আমাদের ছবি ও ভিডিও শেয়ার করছি। 

র‌্যাকুয়েল কারভালহো কাজ করেছেন চিত্রভিত্তিক হয়রানির আন্তর্জাতিক সহযোগিতামূলক প্রকল্পে। ছবি: তু নেইল/ড্যানিয়েল নিকোলাইসন

হংকংয়ের সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট, কোরিয়া টাইমস, ইন্দোনেশিয়ার টেম্পো ম্যাগাজিন, ফিলিপাইন সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম ও ম্যানিলাভিত্তিক এবিএস-সিবিএন-এর রিপোর্টারদের নিয়ে আন্তসীমান্ত এই প্রকল্পের দল গঠন করা হয়। প্রকল্পটি খ্যাতি কুড়িয়েছে সহযোগিতামূলক ও নৈতিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার শক্ত উদাহরণ হিসেবে।

ছয় মাস ধরে চলা এই অনুসন্ধানে সমর্থন দিয়েছে অস্ট্রেলিয়ার জুডিথ নিলসন ইনস্টিটিউট। সাংবাদিকতা শিক্ষা ও অনুদানকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা শুরু করে ২০১৮ সালে। মূল বিষয়বস্তু এবং নিউজরুমগুলোর একত্র হওয়া—দুই দিক থেকেই প্রকল্পটি ছিল অন্য রকম। 

এই প্রকল্পে রিপোর্টাররা যেভাবে গভীর অনুসন্ধান প্রক্রিয়ার সঙ্গে ভুক্তভোগীদের বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং নীতিনির্ধারণী আলোচনার সংযোগ ঘটিয়েছেন, তার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন যুক্তরাজ্যের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক ক্লেয়ার ম্যাকগ্লিন। তাঁর কাজও মূলত চিত্রভিত্তিক যৌন হয়রানি নিয়ে। এতে হয়রানির শিকার নারীদের দিকে যেভাবে মনোযোগ দেওয়া হয়েছে, সেটিরও প্রশংসা করেন ম্যাকগ্লিন। 

তিনি বলেন, “চটকদার ও ‘ক্লিক-বেইট’ রিপোর্টিং নয়, বরং প্রতিবেদনগুলোর ভিত্তি ছিল এই চর্চার ক্ষতিকর প্রকৃতি।”

আন্তসীমান্ত বিষয়, আন্তসীমান্ত দল

প্রকল্পের প্রাথমিক ভাবনাটি এসেছিল সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট থেকে।

এসসিএমপির এশিয়া প্রতিনিধি এবং এই প্রকল্পের প্রধান র‌্যাকুয়েল কারভালহো বলেন, “আমাদের মনে হয়েছিল, এই ইস্যু নিয়ে বেশি রিপোর্টিং হয়নি। আমরা চিত্রভিত্তিক হয়রানি এবং এর বিভিন্ন স্তর খতিয়ে দেখতে চেয়েছিলাম।” তিনি জানান, মর্নিং পোস্টের হংকং নিউজরুমই প্রথম খেয়াল করে যে কোভিড-১৯ মহামারির সময়ে সমস্যাটি গুরুতর আকার ধারণ করেছে। অলাভজনক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনেও চিত্রভিত্তিক হয়রানির ঘটনা বাড়তে দেখা যাচ্ছিল। বিষয়টি নিয়ে কাজ করার জন্য জুডিথ নিলসন ইনস্টিটিউটের কাছে প্রস্তাব দেওয়া হলে তারাও আগ্রহ দেখায়।

কারভালহো এরপর অন্যান্য সংবাদমাধ্যমকে এই প্রকল্পে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানাতে শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত, পাঁচটি নিউজরুম ও কয়েকজন ফ্রিল্যান্সার যোগ দিতে রাজি হন। নবগঠিত দলটি, এরপর অনলাইনে মতবিনিময় সেশন শুরু করে। সেখানে ঠিক করা হয়, তাঁরা কোন কোন বিষয়ের দিকে মনোযোগ দেবেন। তাঁরা এ-ও উপলব্ধি করেছিলেন যে সংবাদমাধ্যমগুলোর পাঠক-দর্শক বিভিন্ন রকমের হওয়ায়, রিপোর্টিং এবং স্টোরিটেলিংয়ের ধরনেও ভিন্নতা থাকতে হবে।

কারভালহো বলেন, “এই দলকে একত্র করার মাধ্যমে, আমরা এমন গল্প তৈরি করতে পেরেছি যা দেখিয়েছে, চিত্রভিত্তিক হয়রানি কত রকমের হতে পারে এবং নারী, শিশু ও পুরুষেরাও কীভাবে এর শিকার হতে পারে।” তিনি বলেন, “আমরা এমনটাই চেয়েছিলাম; এবং মনে হয় দেখাতে পেরেছি যে কীভাবে এটি একটি ক্রমবর্ধমান আন্তসীমান্ত ইস্যু হয়ে উঠেছে এবং এই বিষয় নিয়ে আরও কত কিছু করার আছে।” 

ডিজিটাল নেটিভ থেকে ডিজিটাল ওয়াচডগ

ভিডিও কলের সময় প্রকল্পের সাংবাদিকেরা। ঘড়ির কাঁটা অনুযায়ী, ওপর থেকে: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের র‌্যাকুয়েল কারভালহো; কোরিয়া টাইমসের লি মিন-ইয়ং; ইন্দোনেশিয়ার টেম্পো ম্যাগাজিনের দিনি প্রামিতা; এবং ফিলিপাইন সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমের নিল জেসন সারভালোস। ছবি: স্ক্রিনশট

এই প্রকল্পে অংশ নেওয়া রিপোর্টারদের একজন নিল জেসন সারভালোস। সে সময় তিনি ছিলেন ফিলিপাইন সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমের ফেলো এবং যুক্ত ছিলেন ফিলিপাইন স্টারের সঙ্গে। সদ্য কলেজ পাস করে ২০১৮ সালে সাংবাদিকতা শুরু করেন সারভালোস। এই প্রকল্পে কাজের মাধ্যমে তিনি গল্পের গভীরে যাওয়ার এবং ডিজিটাল অপরাধ অনুসন্ধানের দক্ষতা গড়ে তোলার সুযোগ পেয়েছেন। 

সারভালোস বলেন, “ফিলিপাইনে আমাদের প্রজন্মের অনেক সাংবাদিক কাজ করছেন। আমরা ডিজিটাল জগতেই বড় হয়েছি। এবং একসময় বুঝতে পারি, বিষয়টির সুবিধা আমাদের নেওয়া উচিত।”  

সারভালোস এই বিষয় নিয়ে নিজের জ্ঞান ও দক্ষতা বাড়িয়েছেন ওপেন সোর্স টুল ব্যবহার করে এবং নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে। তিনি বলেন, “প্রযুক্তি, সোশ্যাল মিডিয়া, ভার্চ্যুয়াল কমিউনিটি ইত্যাদি নিয়ে জানাশোনাই আমাদের জন্য ডিজিটাল প্রহরী হিসেবে কাজ করার ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে।”

তাঁর মতে, এটি ফিলিপাইনের রিপোর্টারদের অনেক সহায়তা করেছে। কারণ, এখানে রিপোর্টারদের জন্য এসব রিসোর্স ও প্রশিক্ষণের অভাব আছে এবং মহামারি শুরু থেকে দেশটিতে সাইবার অপরাধ বেড়েছে ব্যাপকভাবে। ২০২০ সালে প্রায় ১২ দশমিক ৯ লাখ চিত্রভিত্তিক শিশু হয়রানির ঘটনা রিপোর্ট হয়েছে। এটি ২০১৯ সালের প্রায় তিন গুণ। 

“সাইবার স্পেসে অপরাধীদের গোপন জগৎ” নিয়ে অনুসন্ধান করার সময় অনলাইনে দুজন বন্ধু খুঁজে পান সারভালোস। তাঁদের একজন ঠিকাদার ও অন্যজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তাঁরা এই রিপোর্টিংয়ে খুবই মূল্যবান ভূমিকা রেখেছেন। 

তিনি বলেন, “এর বাইরে, পডকাস্ট, সংবাদপত্রের লেখালেখি এবং অনলাইনের অন্যান্য সোর্স থেকে পাওয়া জিনিসপত্রও আমরা কাজে লাগিয়েছি। আমার বিশ্বাস, আরও প্রশিক্ষণ ও দিকনির্দেশনা পেলে…আমরা আরও ভালো করতে পারব।”

এই অনুসন্ধানী প্রকল্পের মাধ্যমে সারভালোস শুধু সাংবাদিকতার কিছু বিশেষ টুল ব্যবহারেই দক্ষ হননি, একই সঙ্গে এটি তাঁর কাজকে আরও অর্থবহ করে তুলেছে।

সারভালোস বলেছেন, “যাঁরা অনলাইনে শিশুদের যৌন হয়রানির মতো গোপন অপরাধের শিকার হন, তাঁরা সচরাচর নিজে থেকে এসব গল্প বলতে চান না। কারণ, অনেক সঙ্কোচ এবং নতুন করে মানসিক আঘাত পাওয়ার ঝুঁকি থাকে তাঁদের। কিন্তু এই সাহসী শিশুরা আমাকে যেভাবে তাদের গল্পগুলো বলেছে, তা আমাকে আরও অনেক কিছু করার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। নতুন কিছু করার আহ্বান জানিয়েছে।”

সংবেদনশীলতার সঙ্গে রিপোর্টিং

প্রতিবেদনের জন্য প্রয়োজনীয় সব তথ্য সংগ্রহ এবং ভিকটিমের মানসিক আঘাতের প্রতি সম্মান ও সংবেদনশীলতা বজায় রাখা—এই দুইয়ের মধ্যে সূক্ষ্ম ভারসাম্য রেখে ভুক্তভোগীদের সাক্ষাৎকার নিতে হয়েছে।

“আমরা এই প্রকল্পের জন্য বেশ কিছু সাক্ষাৎকার নিয়েছি। আমরা ১০টি দেশ থেকে চিত্রভিত্তিক হয়রানির শিকার ২০ জন ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিতে পেরেছি,” জানান কারভালহো। এই সাক্ষাৎকারদাতাদের তাঁরা খুঁজে বের করেন বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, অ্যাডভোকেট, বিশেষজ্ঞ ও অলাভজনক সংগঠনের মাধ্যমে।  

“আমার মতে, হয়রানির শিকার কোনো ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় দুটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ: বিবেচনাবোধসম্পন্ন হওয়া এবং ভুক্তভোগীকে দোষারোপ করার মনোভাব ত্যাগ করা। প্রশ্নগুলো কীভাবে সাজাব, রিপোর্টিং প্রক্রিয়া অথবা কেন নির্দিষ্ট কোনো তথ্য গুরুত্বপূর্ণ ইত্যাদি বিষয় কীভাবে ব্যাখ্যা করব—এগুলো নিয়ে আমি যতটা সম্ভব সতর্ক থাকার চেষ্টা করি। তাঁদের ব্যক্তিগত পরিধিকে সম্মান জানানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করি,” বলেন কারভালহো।

আরেকটি প্রধান বিবেচ্য বিষয় হলো, সাক্ষাৎকারদাতাদের নাম-পরিচয় যেন গোপন থাকে, তা নিশ্চিত করা। এবং এমন তথ্য প্রকাশ না করা, যা থেকে তাঁদের পরিচয় শনাক্ত করা যায় অথবা যা তাঁদের আরও প্রকাশ্য করে তোলে। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে ভুক্তভোগীরা তাঁদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত এবং হয়রানিকারীদের কাছ থেকে এখনো হুমকি পাচ্ছেন।  

সাক্ষাৎকারগুলোর কথা স্মরণ করে কারভালহো বলেন, “এই সিরিজের জন্য যেসব ভুক্তভোগীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে, তাঁদের কেউ কেউ বিষণ্নতা ও দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। একটি নির্দিষ্ট সাক্ষাৎকার নেওয়া খুবই কঠিন ছিল। সেখানে ভিকটিম আমাকে বলেছিলেন, পর্নহাব ও অন্যান্য ওয়েবসাইটে তাঁর ভিডিও আছে জানার পর তিনি আত্মহত্যার চিন্তা করেছিলেন।”

অনুসন্ধানের জন্য ছবি তৈরি করার জন্য সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের রিপোর্টিং দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন গ্রাফিক শিল্পী কালিজ লি। ছবি: স্ক্রিনশট

হয়রানির শিকার ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় সতর্ক থাকা এবং তাঁদের অভিজ্ঞতাকে মর্যাদাপূর্ণ উপায়ে উপস্থাপন করার বিষয়টি নিয়ে কারভালহোর দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিধ্বনি করেছেন ক্লেয়ার ম্যাকগ্লিন। তাঁর মতে, এসব বিষয় নিয়ে কাজ করার সময় ভিকটিম-দোষারোপের ভাষা ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

“প্রথমেই, সঠিক পরিভাষা ব্যবহার করুন, যেটি ভুক্তভোগীদের সমর্থন করবে এবং অন্যান্য মনোভাবকে চ্যালেঞ্জ জানাবে। যেমন, “রিভেঞ্জ পর্ন” একটি ভিকটিম-দোষারোপের ভাষা। এটি থেকে এমন ইঙ্গিত দেওয়া হয় যে ভিকটিম খারাপ কিছু করেছেন এবং হয়রানিকারীদের কর্মকাণ্ডের ন্যায্যতা আছে, এবং আসলে ভিকটিমই দোষী,” বলেন কারভালহো। 

তিনি আরও বলেন, “অনেক ভুক্তভোগীই এই পরিভাষার কারণে বিষয়টি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন না। কারণ, এতে তাঁরা নিজেদেরই দোষী বলে ভাবতে থাকেন। এর চেয়ে বরং ‘চিত্রভিত্তিক যৌন হয়রানি’ ও ‘অন্তরঙ্গ ছবির অপব্যবহার’ এই পরিভাষাগুলো ভালো। কারণ, এতে স্পষ্টভাবে বলা হচ্ছে, এই কর্মকাণ্ডগুলো ঠিক নয়।”

হয়রানিকারীরা (বেশির ভাগই পুরুষ ও ছেলে) কেন এমন করছে এবং এটি রোধে কী করা যায়—এমন প্রশ্নের ওপর মনোযোগ দেওয়ার গুরুত্বও তুলে ধরেছেন ম্যাকগ্লিন। তিনি বলেছেন, “আমাদের মনোযোগ এটি হওয়া উচিত নয় যে, এসব হয়রানি ‘রোধ করতে’ ভুক্তভোগীরা, বা সাধারণভাবে নারীরা, কী করতে পারতেন। যেমন  সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁদের প্রাইভেসি সেটিংস পরিবর্তন করা উচিত কি না, বা নগ্ন ছবি পাঠানো ঠিক কি না; ইত্যাদি বিতর্ক।”

অন্ধকার জগতে ডুবে থাকা

এই ধরনের ব্যক্তিগত গল্প শোনা, রেকর্ড করা এবং সূক্ষ্মভাবে রিপোর্ট করার মানসিক চাপ এমনিতেও খুব বেশি। এর সঙ্গে যোগ হয় গবেষণা। বিশেষভাবে বেশ কিছু পর্নোগ্রাফিক ওয়েবসাইট ও চ্যাট রুম পর্যবেক্ষণ করা এবং সেগুলো প্রতিনিয়ত দেখতে থাকা অত্যন্ত চাপের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এই জায়গাগুলো নিয়ে কাজ করতে গেলে নিরাপত্তাসংক্রান্ত যে ঝুঁকি থাকে, সেটিও মোকাবিলা করতে হয় রিপোর্টারদের। কারণ, এর আগে অ্যাকটিভিস্টদের ব্যক্তিগত তথ্য অনলাইনে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছিল।

অনুসন্ধানী সাংবাদিক কারভালহোর এই পরিসরে কাজ করার অভিজ্ঞতা এক দশকের বেশি। জটিল আবেগঘনিষ্ঠ বিষয় কাভার করার অভিজ্ঞতাও তাঁর নতুন নয়। কিন্তু এই প্রকল্পের বিশালত্ব ও জটিলতা তাঁকেও মানসিক চাপে ফেলে দিয়েছিল। 

“টানা কয়েক মাস ধরে এই অন্ধকার জগতের মধ্যে ডুবে থাকাটা চ্যালেঞ্জের বটে, এবং এই কাজের সঙ্গে জড়িত বেশ কয়েকজন রিপোর্টারের মনে এটি গভীর প্রভাব ফেলেছে,” বলেন কারভালহো। তিনি আরও ব্যাখ্যা করে বলেন, প্রতিদিন নতুন নতুন পোস্ট স্ক্রল করতে করতে, তিনি কত রকমের উদ্বেগজনক ছবি ও ভিডিও দেখতেন। এবং এর মধ্যে ধর্ষণ এবং নারীর সম্মতি ছাড়া ধারণ করা ভিডিও-ও থাকত। তিনি এমন একটি গ্যালারির কথা বলেছেন, যেটি পূর্ণ হয়ে আছে অল্প বয়সী শিশুদের (ছেলে, মেয়ে; উভয়ই) ছবি ও ভিডিও দিয়ে। সেগুলো আবার অনলাইনে শেয়ার এবং বেচাবিক্রিও হচ্ছিল।

“এই ধরনের কন্টেন্ট কত সহজে পাওয়া যায় এবং চিত্রভিত্তিক হয়রানির শিকার হওয়া ব্যক্তিদের (বিশেষভাবে মেয়ে ও নারী) ওপর এর কী প্রভাব পড়ে, এই বিষয়গুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এড়িয়ে যাওয়া হয়। ফলে বিশেষ করে একজন নারী সাংবাদিক হিসেবে, বিপর্যস্ত ও হতাশ হয়ে পড়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। এসব গ্রুপের সদস্যরা নিজেদের মধ্যে যেভাবে কথাবার্তা বলেন, তা দেখাও হতাশাজনক। কারণ, সেখানে এই ইস্যুটি খুবই হালকাভাবে নেওয়া হয়। অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোতে এমন হয়রানি রিপোর্ট করার পদ্ধতি খুব দুর্বল ও অপর্যাপ্ত, যা হতাশা আরও বাড়ায়।”

এত কিছুর পরও, এসব আবেগ এক পাশে রেখে তাঁকে রিপোর্ট করতে হয়েছে বস্তুনিষ্ঠভাবে; তিনি যা দেখেছেন ও শুনেছেন, তার ওপর ভিত্তি করে। তাঁকে আরও মাথায় রাখতে হয়েছে: প্রতিবেদন প্রকাশের পর ভিকটিমের পরিণতি কী হবে, এবং এসব কর্মকাণ্ডের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের কীভাবে জবাবদিহি করা যাবে। সব মিলিয়ে বিষয়টি ছিল চ্যালেঞ্জিং। এবং সবকিছুই ছিল এই রিপোর্টিং প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। 

অনুসন্ধানটি এমন একটি ইস্যুর ওপর আলো ফেলেছে, যা নিয়ে আগে খুব একটা রিপোর্টিং হয়নি। একই সঙ্গে দেখিয়েছে যে একটি সাংবাদিকতা প্রকল্প কীভাবে যৌন হয়রানিকে ঘিরে চালু থাকা অনেক প্রথাগত, ছাঁচেঢালা ধারণাকে ধুলিসাৎ করে দিতে পারে। শুধু রিপোর্টিং বা ভাষার ব্যবহার নয়, চিত্রায়ণের মাধ্যমেও। কারভালহো ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন গ্রাফিক শিল্পী কালিজ লি-এর সঙ্গে, যেন হয়রানির শিকার ব্যক্তিদের সম্মানজনক উপায়ে চিত্রিত করা যায়।

অনুসন্ধানের জন্য ছবি তৈরি করার জন্য সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের রিপোর্টিং দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন গ্রাফিক শিল্পী কালিজ লি। ছবি: স্ক্রিনশট

এটি এই অঞ্চলে নতুন উদাহরণও তৈরি করেছে। “আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এমন জোট বাঁধার ঘটনা ক্রমে বাড়ছে। সেটি খুব দারুণ ব্যাপার। কিন্তু এশিয়াভিত্তিক কোনো সংগঠন এমন জোটে নেতৃত্ব দিচ্ছে, বিশেষভাবে এশীয় কমিউনিটির দিকে মনোযোগ দিচ্ছে, এবং এই অঞ্চলের গল্পগুলো দুনিয়ার অন্যান্য প্রান্তের সামনে তুলে ধরছে—এমন উদাহরণ এখনো খুব বেশি দেখা যায় না,” বলেন কারভালহো। তিনি আশা করছেন, ভবিষ্যতে এমন আরও অনেক জোটবদ্ধ প্রকল্প দেখা যাবে। 

প্রতিবেদনে যেসব ভুক্তভোগীর উদাহরণ এসেছে, তাঁদের অনেকে পরবর্তীকালে এই রিপোর্টিং দলকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। কারণ, এই প্রকল্পের মাধ্যমে এমন এক বৈশ্বিক ইস্যুর দিকে আলো ফেলা হয়েছে, যেটি আরও বেশি মনোযোগের দাবি রাখে। এবং এই প্রক্রিয়ার অংশ হতে পেরে তাঁদের একধরনের আত্মমর্যাদার অনুভূতি হয়েছে। 

সম্পাদকের নোট: এশিয়ান স্টোরিজ ইনিশিয়েটিভের আওতায় ডিজিটাল সেক্স ক্রাইম প্রজেক্ট-এর আর্থিক সহায়তা দিয়েছে জুডিথ নিলসন ইনস্টিটিউট। জেএনআই, জিআইজেএন-এর সদস্য সংগঠন এবং ২০২১ গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সের সহ-আয়োজক। ফিলিপাইন সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম-ও জিআইজেএন-এর সদস্য। 

জিআইজেএন থেকে লেখাটি বিজেসি পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো।