‘আসাঞ্জের মামলা মুক্ত সাংবাদিকতার পরিপন্থী’


‘আসাঞ্জের মামলা মুক্ত সাংবাদিকতার পরিপন্থী’

যুক্তরাজ্যে জুলিয়ান আসাঞ্জকে হস্তান্তরের মামলা চলছে। আগামী ৪ জানুয়ারি রায়। সে বিষয়েই কথা বলেছেন আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ নিল মেলজার। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ডয়েচে ভেলে’র সেই সাক্ষাৎকারটি হুবহু নিচে দেয়া হলো।

ডিডাব্লিউ: চার সপ্তাহ শুনানির পরে আগামী ৪ জানুয়ারি বিচারক ভ্যানেসা ব্যারিস্টার জুলিয়ান আসাঞ্জের হস্তান্তর মামলার রায় দেবেন। আপনি পুরো মামলাটি খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখেছেন। আপনার কি মনে হচ্ছে?

নিল মেলজার: আদালতে যে ভাবে মামলা এগিয়েছে তাতে মানবাধিকারের বিষয়গুলি খুব গুরুত্ব পেয়েছে বলে মনে হয়নি। যে ভাবে হস্তান্তরের আবেদন জানানো হয়েছে, তা খুব আইনসিদ্ধ বলে মনে হয়নি। গণমাধ্যমের কর্মকর্তাদের বিষয়টির দিকেও নজর দেওয়া হয়নি। জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে মার্কিন আদালত গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে। অথচ তিনি ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম অর্থাৎ, মুক্ত সাংবাদিকতা করেছেন।

উনি সরকারের গোপন নথি জনসমক্ষে নিয়ে এসেছেন। কিন্তু তিনি সরকারি চাকরি করতেন না। ফলে এ কাজে তাঁর কোনো বাধা ছিল না। তথ্যগুলি তিনি চুরিও করেননি। তাঁর কাছে তথ্যগুলি কেউ পৌঁছে দিয়েছিল। তিনি কেবল তা সামনে এনেছেন। এবং প্রতিটি বিষয়ই জনগণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ফলে তিনি কোনো অন্যায় করেননি।

উইকিলিকসের নথি সাধারণ মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কেন?

গুরুত্বপূর্ণ কারণ, ওই নথিতে অনেক জরুরি তথ্য আছে, যা মানুষের জানা উচিত। সরকার কীভাবে দুর্নীতি করেছে, যুদ্ধাপরাধ করেছে তার স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে ওই নথিগুলিতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যথেষ্ট অস্বস্তি হয়েছে বলেই তারা তদন্তমূলক সাংবাদিকতাকে বন্ধ করতে চাইছে। অপরাধ হিসেবে দেখাতে চাইছে। সে কারণেই আসাঞ্জের হস্তান্তর চেয়ে তারা যুক্তরাজ্যের আদালতে মামলা করেছে। দুঃখজনক বিষয় হলো, যুক্তরাজ্যের সিস্টেম ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিস্টেম থেকে বিশেষ আলাদা নয়। চার সপ্তাহের মামলায় বার বার একটি বিষয় চোখে পড়েছে। যুক্তরাজ্য আসাঞ্জের মৌলিক অধিকারগুলিকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। আত্মপক্ষ সমর্থনের যথেষ্ট সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। তাঁকে সলিটারি কনফাইনমেন্টে রাখা হয়েছে। যেখানে পরিবার, বন্ধু-- কারো সঙ্গে দেখা করতে পারছেন না তিনি। মানসিক ভাবে অ্যাসাঞ্জ বেশ ভেঙে পড়েছেন। বেশিদিন আইসোলেশনে থাকলে এমনই হয়।

আপনি ২০১৯ সালের মে মাসে আসাঞ্জের সঙ্গে দেখা করতে গেছিলেন। তার এক মাস আগেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। তখন তাঁর শারীরিক অবস্থা কেমন ছিল?

শরীরিক অবস্থা খুব ভালো ছিল না। আমি দুইজন চিকিৎসককে সঙ্গে করে নিয়ে গেছিলাম। একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং অন্যজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ। দুইজনেই বলেছিলেন, মানসিক অবসাদ এবং মানসিক অত্যাচারের সমস্ত চিহ্ন তাঁরা পেয়েছেন।

তাঁকে অ্যামেরিকার হাতে তুলে দেওয়া হতে পারে, এটাই আসাঞ্জের চিন্তার সব চেয়ে বড় কারণ ছিল। অ্যামেরিকায় কী ধরনের শুনানি হতে পারে, তা নিয়ে অনেক কথা বলেছেন তিনি।
আসাঞ্জের মতো ব্যক্তিদের শুনানি অ্যামেরিকায় খুব নিরপেক্ষ হয় না। গোপন নথি সামনে রেখে বন্ধ ঘরে তাদের শুনানি হয়। কেউ সেই শুনানি শুনতে পারেন না। । ডিফেন্সের আইনজীবীদেরও ওয়াশিংটন নিযুক্ত করে। ফলে তাঁরা যে নিরপেক্ষভাবে শুনানিতে অংশ নেন না, তা বোঝাই যায়। এখনো পর্যন্ত গুপ্তচরবৃত্তির মামলায় কোনো ব্যক্তি মুক্তি পাননি। সকলকেই শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে।

অভিযোগ প্রমাণ হলে এই ব্যক্তিদের বিশেষ ডিটেনশন সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। যাকে স্পেশাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ মেসার বলা হয়। যেখানে অপরাধীদের বছরের পর বছর আইসোলেশনে রাখা হয়। তাঁরা কারো সঙ্গে কথা বলতে পারেন না। দিনে ৪৫ মিনিটের জন্য সেল থেকে বার করা হয় অপরাধীদের। ওইটুকু সময় তাঁরা হাঁটতে পারেন। কিন্তু তখনো কারো সঙ্গে কথা বলা যায় না। মানসিকভাবে অপরাধীরা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েন। এ ছাড়াও নানা অন্যায় ব্যবহার করা হয় অপরাধীদের সঙ্গে। মানবাধিকারের কোনোরকম তোয়াক্কা করা হয় না। আমি বলছি না, অ্যামনেস্টিও একই কথা একাধিকবার বলেছে।

গত ১০ বছর ধরে এই বিষয়টিই ভাবিয়েছে জুলিয়ান আসাঞ্জকে। তাঁর মানসিক স্বাস্থ্যের উপর এই বিষয়টি খুবই প্রভাব ফেলেছে। প্রথমে তাঁকে আলাদা সেলে রাখা হয়েছিল। সলিটারি সেলে নয়। সেখানে তিনি দিনে দুই-তিনবার অন্য বন্দিদের সঙ্গে কথা বলতে পারতেন। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে ফিরে তাঁকে আইসোলেশন ওয়ার্ডে রাখা হয়। এরপরই কোভিড সংক্রমণ শুরু হয়। অ্যাসাঞ্জকে তারপর আর আইসোলেশন ওয়ার্ড থেকে বের করা হয়নি।

আপনি অ্যাসাঞ্জের পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাজ্যের প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। তাঁদের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?

আমি যুক্তরাজ্যের প্রশাসনের সঙ্গে বিতর্ক করেছিলাম। যেভাবে আসাঞ্জকে রাখা হয়েছে, তা যে আইনবিরুদ্ধ তা জানিয়েছিলাম। তাঁর বিরুদ্ধে হস্তান্তরের মামলাও বাতিল করার আবেদন জানিয়েছিলাম।

ব্রিটিশ আদালতে নীতির লঙ্ঘন হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছিলাম। কোভিডের কারণে অ্যাসাঞ্জের আইনজীবীকে ছয় মাস তাঁর সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। তাঁরা কেবলমাত্র ফোনে কথা বলতে পেরেছেন। অথচ উল্টোদিকে অ্যামেরিকা অসংখ্য আইনজীবীকে সঙ্গে নিয়ে আসাঞ্জের বিরুদ্ধে মামলা সাজিয়েছে। এটা পরিষ্কার আদালতের নীতির লঙ্ঘন। সকলে সমান সুযোগ পাননি। যুক্তরাজ্যের প্রশাসন কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখায়নি। অথচ আমার আবেদন ভুল, এমন কথাও তারা বলতে পারেনি। আমার সঙ্গে কোনো বিতর্কে যেতেও রাজি হয়নি। তারা আমার বক্তব্যের কোনো উত্তরই দেয়নি। কিছুদিন আগেও এই মামলা নিয়ে আমি মন্তব্য করেছিলাম। কিন্তু তখনো কোনো উত্তর দেওয়া হয়নি আমায়।

অ্যাসাঞ্জকে গৃহবন্দি করা যেত। এর আগে অনেকের সঙ্গেই তা করা হয়েছে। অগুস্তো পিনোচেটের সঙ্গে তা করা হয়েছে। চিলির সাবেক একনায়ক ১৮ মাস ধরে লন্ডনে আছেন। তাঁরও হস্তান্তরের মামলা চলছে। তাঁকে কড়া নিরাপত্তায় জেলে বন্দি করা হয়নি। একটি ভিলায় বন্দি করে রাখা হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার তাঁর সঙ্গে দেখা করেছেন। তাঁর জন্য হুইস্কিও নিয়ে গিয়েছেন।

মনে রাখা ভালো, এই ধরনের মামলায় বন্দির সঙ্গে অপরাধীর মতো আচরণ করা যায় না। হস্তান্তরের রায় হলে বন্দি যাতে পালিয়ে যেতে না পারেন, সে কারণেই তাঁকে আটক রাখা হয়। অথচ অ্যাসাঞ্জের সঙ্গে যা হচ্ছে, তা বড় বড় অপরাধীদের সঙ্গে করা হয়।

প্রসঙ্গত; নিলস মেলজার জেনেভা অ্যাকাডেমি অফ ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যানিটেরিয়ান ল অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের বিশিষ্ট সদস্য। গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি আন্তর্জাতিক আইনের অধ্যাপক।

 

খবর সূত্র: ডয়েচে ভেলে