সাংবাদিকরা শ্রমিক, নেই শ্রম অধিকার


সাংবাদিকরা শ্রমিক, নেই শ্রম অধিকার

১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের অধিকার আদায়ের জন্য জীবন দিয়েছিলেন শ্রমিকরা । আজ ১৩৫ বছর পর সব শ্রেণীপেশার শ্রম অধিকার পুরোপুরি আদায় না হলেও অনেককাংশে আদায় হয়েছে। কিন্তু সাংবাদিকদের শ্রম অধিকার কতটুকু আদায় হয়েছে? সাংবাদিকতার শুরু থেকে লক্ষ করলে দেখা যাবে বিশেষ করে বাংলাদেশে সাংবাদিকরা বরাবরই শোষণ-বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন।

সাংবাদিকদের বেতন ব্যবস্থার দিকে তাকালে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়। বাংলাদেশে পত্রপত্রিকার সাংবাদিকদের বেতন-ভাতার জন্য নবম মজুরি বোর্ড অনুসরণ করার কথা থাকলেও কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানা হয় না সেই মজুরি বোর্ড৷ এ তো গেলো সংবাদপত্র ও বার্তা সংস্থার বেতন ব্যবস্থা। যারা টেলিভিশন বা অনলাইন সাংবাদিক আছেন তাদের অবস্থা আরও শোচনীয়।

টেলিভিশন এবং অনলাইন সাংবাদিকদের জন্য নেই কোনো আলাদা মজুরি বোর্ড। এমনকি তাদের বেতন ব্যবস্থা সংবাদপত্রের মজুরি বোর্ডের মধ্যেও অন্তর্ভুক্ত নয়। টেলিভিশন সাংবাদিকদের বেতন নির্ধারিত হয় মালিকপক্ষের ইচ্ছায়। সেই ক্ষেত্রে দেখা যায় অনেক সময় তাদের বেতন সংবাদপত্রের সাংবাদিকদের থেকে অনেক কম।

এছাড়াও শ্রম আইনে আটঘণ্টা কাজ করার কথা থাকলেও সাংবাদিকতা পেশার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে সাংবাদিকরা বেশীরভাগই আট ঘণ্টার বেশি সময় কাজ করছেন। ছুটির দিনেও তাদের নেই কোনো ছুটি। এই যে বাড়তি সময়টুকু তার জন্য পাচ্ছেন না কোনো বাড়তি বেতন। চাকুরীর তুলনায় প্রার্থী বেশি হওয়ায় মালিকপক্ষ স্বল্প বেতনে কাজ করিয়ে নিচ্ছেন সাংবাদিকদের।

আবার কোনো প্রতিবাদ না করেও বিনা কারণে চাকুরী হারাচ্ছেন অনেকে এজন্য চাকরিচ্যুতির ভয়ে কেউ এই বিষয়ে প্রতিবাদও করতে চান না। এত শোষণ-বঞ্চনার মধ্যে বেতন-ভাতা নিয়েও রয়েছে নানা অভিযোগ। অনেকের চার মাসের বেতন আটকে থাকে তো অনেকের ছয় মাসের বেতন আটকে থাকে। বাংলাদেশে প্রায়ই দেখা যায় বিভিন্ন গণমাধ্যম হাউজের সাংবাদিকরা বেতনের জন্য আন্দোলন করেন বিক্ষোভ করেন। যেখানে বেতন আদায়ের জন্যই আন্দোলন করতে হয় সেখানে বোনাসের প্রশ্ন করাও যেন অপরাধ।

সাংবাদিকদের বেতন ব্যবস্থার প্রশ্নে বিজেসির ট্রাষ্টি ও মাছরাঙা টেলিভিশনের জ্যেষ্ঠ বার্তা সম্পাদক রাশেদ আহমেদ বলেন, ‘টেলিভিশন সাংবাদিদের জন্য বেতন কাঠামো সরকার এখনও পর্যন্ত তৈরি করেনি। এটি কোন কাঠামোর মধ্যে পড়বে তা এখনও চিন্তা-ভাবনার পর্যায়ে রয়েছে। পত্রপত্রিকার যে ওয়েজ বোর্ড আছে সেই ওয়েজ বোর্ডে টেলিভিশন পড়ে না কারণ এখানে কাজের ভিন্নতা আছে। কাদেরকে আমরা টেলিভিশনের সাংবাদিক বলব এবং সংবাদকর্মী বলব এই জায়গাটা এখনও নির্ধারণ হয়নি। টেলিভিশনে প্রডিউসার যারা, ভিডিও এডিটর যারা, গ্রাফিক্সের কাজ করেন যারা তাদেরকে আমরা সংবাদকর্মী বলব কিনা এই জায়গাটা এখনও স্পষ্ট না। এই কারণে বড় একটা জটিলতা তৈরি হয়েছে। সরকারের সাথে টেলিভিশনের বেতন কাঠামো তৈরি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।’

শ্রম আইনে আটঘণ্টা কাজ করার কথা থাকলেও সাংবাদিকতা পেশার ক্ষেত্রে সেটি মেনে চলা সম্ভব হচ্ছে কিনা এই প্রশ্নের জবাবে রাশেদ আহমেদ বলেন, ‘সাংবাদিকতা হচ্ছে একটি সৃজনশীল কাজ। এখানে সময় বেঁধে দিয়ে কোনো কাজ হয় না। দেখা যায় অনেকক্ষেত্রে আট ঘণ্টায় সাংবাদিকদের প্রতিবেদন তৈরি শেষ হচ্ছে না কিন্তু সেই কাজটি ওইদিনই শেষ করতে হবে তখন কি আমি কাজটি শেষ না করে চলে আসব? সেটি তো হতে পারে না। সাংবাদিকরা কখনও বারো ঘণ্টা কাজ করে কখনও ষোল ঘণ্টা কাজ করে সেক্ষেত্রে এটা হতে পারে যে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তাদের যে প্রাপ্যটা সেটি তারা পাচ্ছে কিনা সেটি নিশ্চিত করতে হবে। আমরা যেটা জানি সাংবাদিকদের সৃজনশীল কাজের যে মজুরি সেটি তাদের দেওয়া হয় না। প্রত্যেকটা টেলিভিশন তাদের মত করে সাংবাদিকদের বেতন কাঠামো নির্ধারণ করছে। এর ফলে তৈরি হচ্ছে ব্যাপক বৈষম্য।’

সাংবাদিকদের ছুটির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অন্যান্য সব পেশায় বিভিন্ন দিবসে সরকারি ছুটি থাকলেও সাংবাদিকতায় এমন কোনো ছুটি নেই। উল্টো এসব দিবসে সাংবাদিকদের আরও বেশি কাজ করতে হয়। সরকারি ছুটির দিনগুলোতে যেসব সংবাদকর্মীরা কাজ করেন তাদেরকে যেন আলাদা করে সম্মানী দিয়ে পুষিয়ে দেওয়া হয়। যেমন আজকে মে দিবস হিসেবে সব অফিস ছুটি আজকে যেসব সাংবাদিক কাজ করবেন তাদের এই কাজকে ওভারটাইম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তেমনি অন্যান্য সরকারি ছুটির দিন গুলোতে কাজ করলে দৈনিক বেতনের দ্বিগুণ দিয়ে পুষিয়ে দেওয়া হয়। এটাই আমাদের দাবি। পাশাপাশি আরেকটি বিষয়ে দাবি জানাই সেটি হচ্ছে সরকার ঘোষণা দেওয়ার পরও অনেক টেলিভিশন চ্যানেল সাংবাদিকদের বৈশাখী ভাতা দিচ্ছে না। সেটি যেন দেওয়া হয়।’

অন্যান্য পেশার ক্ষেত্রে শ্রম অধিকার আদায়ের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে শ্রম আইনের পুরোপুরি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। সেটি বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, শ্রম মন্ত্রণালয়ের যে তদারকি থাকা দরকার সেটি থাকছে না। ফলে এই আইন বাস্তবায়ন হচ্ছে না। বিশেষ করে পোশাক খাতে শিল্পপতিরা কর্মীদের শ্রম আইন অনুযায়ী বেতন দিচ্ছেন না। প্রতি ঈদের আগেই দেখা যায় রাস্তা অবরোধ হয়, ধর্মঘট হয় বেশিরভাগ গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির সামনে। এই চিত্রই বলে দিচ্ছে বাংলাদেশে আসলে শ্রম আইন কতটুকু বাস্তবায়িত হচ্ছে।